চারদিক থেকে নদী বেষ্টিত একটি দ্বীপ। যার চরের চারপাশের জলাশয়ে পানি আছে। কিন্তু বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট। আশেপাশে নেই কোন গভীর নলকূপ। রান্না এবং পান করার জন্য খালের পানিই এখানকার মানুষের ভরসা। এতে দিনদিনই সাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

বিশুদ্ধ পানির এমন হাহাকার ‘কাউখালী’ চরের বাসিন্দাদের। চরটির ভৌগলিক অবস্থান পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নে। আগুনমুখা নদী ঘেঁষেই চরটি জেগে উঠেছে। নদীর শাখা-উপশাখা ঘিরে রেখেছে চরটিকে। বিস্তীর্ণ জলাশয়ের এ চরে পানির অভাব নেই। কিন্তু নদীর সঙ্গে মিশে থাকা জলাশয়ের এ পানি লবণাক্ত। এছাড়া জলাশয়ের পাশে পাশে রয়েছে পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য খোলা টয়লেট। তাই সেখানে বিশুদ্ধ পানির সংকট বারো মাস । সুপেয় পানির জন্য রীতিমত হাহাকার চলে সেখানে।

সুপেয় পানির জন্য খাল-নালা ডেঙিয়ে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘপথ। তাই বিকল্প নৌপথে কলস ভরে ট্রলারে পানি আসে এ চরে। এজন্য দিতে হয় তেল খরচের টাকা। কিন্তু সবসময় সে পথে পানি আনাও সম্ভব নয়। তখন আর কি উপায়? নদী কিংবা খালের পানিই ফিটকিরি দিয়ে বিশুদ্ধ করে খেতে হয়।

সেই চিত্র দেখতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের চাঁন বাজার। সেখান থেকে সেতু পেড়িয়ে উত্তর দিকে এগুলো কাউখালী চর। জনবসতি আছে প্রায় এক শ’। কিন্তু হাতেগোনা নলক‚প আছে মাত্র দুই-তিনটি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নদী ও খাল তীরবর্তী অর্ধশত বাড়ি থেকে সেই নলকূপের দূরত্ব প্রায় তিন-চার কিলোমিটার। ছোট ছোট খাল-নালা ও আকা-বাকা পথ পেড়িয়ে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করাও অনেক কষ্টসাধ্য।

এনিয়ে ওই চরের গৃহিণী পারভীন বেগমের সঙ্গে বুধবার বিকেলে কথা হয়। তখন তিনি রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত। তার বাড়ির পাশের খাল থেকে আনা পানিতে ফিটকিরি চুবিয়ে বিশুদ্ধ করে নিচ্ছিলেন। পরে সেই পানি দিয়েই মাছ রান্না করছিলেন তিনি। রান্নার ফাঁকে আলাপকালে পারভীন বেগম বলেন, ‘আমরা পানির জন্য অনেক কষ্ট করি। কল (নলকূপ) অনেক দূর। বেশিরভাগ সময় খালের পানি দিয়ে এইভাবে রান্না করি।’

জানা গেছে, প্রায় ১৫ বছর আগে কাউখালী চরে বসতি গড়ে উঠেছে। সেখানকার মানুষজন কৃষি, মৎস্য ও পশু পালনের পেশায় নিয়োজিত। চরের বাসিন্দারা জানান, আগুনমুখা নদী পেড়িয়ে পার্শ্ববর্তী গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি কিংবা ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকা থেকে ট্রলারযোগে গভীর নলকূপের সুপেয় পানি আনতে হয় এ চরে। ট্রলারের তেল পুড়ে পানি আনতে খরচও হয় চার থেকে পাঁচ শত টাকা। কিন্তু নদী উত্তাল থাকলে তাও জোটে না সবসময়। তখন চরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা আগুনমুখা নদী কিংবা কাউখালী খালের পানিই একমাত্র ভরসা।

এই চরে ১০ বছর ধরে বসবাস করছেন শহিদুল সরদার। পেশায় তিনি কৃষক। বাড়ির পাশের খাল থেকে কলসে করে পানি নেওয়ার সময় শহিদুলের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। শহিদুল বলেন, ‘এই জায়গায় কোন কল (গভীল নলকূপ) নাই। আমরা পানপট্টি আর চরফ্যাশন থেকে ট্রলারে করে ড্রাম, কলস, পট ভরে পানি আনি। এইজন্য ট্রলার ভাড়া দেই। প্রত্যেকবার এক-দেড় শ’ টাকা ভাড়া দেওয়া লাগে। যখন পানি পাই না, তহন এইভাবে খাল থেকে পানি নেই। সেই পানিতে ফিটকিরি দিয়া খাই। বর্ষায় কলের পানিটা কম আনতে পারি। তহন (তখন) দরিয়ায় (নদী) তুফান (ঢেউ) থাহে। আবহাওয়া খারাপ হলে ট্রলার যাইতে পারে না। তহন বৃষ্টির পানি ড্রাম ভরে রাখি। ওইয়া দিয়াই রান্নাবান্না খাওয়া দাওয়া চলে।’

চরটি ঘুরে দেখা গেছে, বেড়িবাঁধ না থাকায় এবং নদী তীরবর্তী হওয়ায় চরটির পুকুরগুলোতেও লবণাক্ততা ছড়িয়ে গেছে। ফলে সে পানি পান করা যায় না। তাই ড্রামে পানি সংগ্রহ করে ফিটকিরি দিয়ে বিশুদ্ধ করে চলে রান্নাবান্না এবং গৃহস্থালি কাজ। আর খাবার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে আনা নলক‚পের পানি সংরক্ষণ করা হয় কলস, পট এবং বোতলে। পানি ফুড়িয়ে গেলে আর কি করার, তখন জীবন বাঁচাতে নদী-খালের পানিই ভরসা। কিন্তু এরফলে পানিবাহিত রোগ দেখা দিতে পারে চরে; বলছেন বাসিন্দারা। চরের বাসিন্দাদের দাবি, নদী ও খাল তীরবর্তী বাসিন্দাদের জন্য সরকারিভাবে গভীর নলক‚প স্থাপনের উদ্যোগ নিলে তাদের পানির কষ্ট লাঘব হবে।

জানা গেছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে সমগ্র বাংলাদেশের নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পে প্রতি অর্থবছরে এ উপজেলায় ১৩০টি গভীর নলকূপ বরাদ্দ দেওয়া হয়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও এই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অপ্রয়োজনীয়ভাবে ঘন ঘন নলকূপ স্থাপন হলেও এতদিনেও কাউখালী চরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গভীর নলকূপ স্থাপন হয়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী সাথী বেগম বলেন, ‘কাউখালী চরের বিষয়টি আমরা জানলাম। ওখানে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। বিষয়টি আমি উর্ধ্বতণ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে ব্যবস্থা নিবো।’

শীঘ্রই সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হবে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান জানান, কাউখালী চরের বাসিন্দাদের খাবার পানির সংকটের বিষয়টি আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম। চরটি আমাদের মূল লোকালয় থেকে অনেক দূরে হওয়ায় বাসিন্দারা এসে পানিও নিতে পারে না। বিষয়টি আগে আমাদের নজরে আসেনি। অতি শিগগরই কাউখালী চরের বাসিন্দাদের জন্য আমরা সুপেয় পানির ব্যবস্থা করবো। কয়টি পরিবার আছে, আমি তা সরেজমিনে পরিদর্শন করে গভীর নলকূপ স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’