জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী আদনান। জন্মের দের বছর পর বাবা মা বুঝতে পারে হয়তো শারীরিকভাবে অক্ষম তাদের ছেলে। ১৮ মাস বয়সে বসা শিখে এবং প্রায় ৭ বছর বয়সে দাঁড়ানো শিখা। তারও প্রায় ২ বছর পর হাটতে শিখে আদনান। ৯ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের কোলে উঠেই প্রাথমিকে পড়া শেষ করে। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার ২৭ এপ্রিল গুচ্ছের এ ইউনিটের পরীক্ষা দিতে এসে সন্তান আদনান উজ জামানের বর্ণনা এভাবেই দিচ্ছিলেন তার মা সাবিনা সুলতানা। আদনান কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে ২০২৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এইচ এস সি পাশ করেন। তার বাড়ি কুষ্টিয়ার অধীন আরোয়াপাড়ায়। তার বাবার নাম আজগর আলী। আদনানের মা বাবা উভয়ই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত রয়েছেন। মায়ের দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় শারীরিক ভাবে অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও লেখাপড়ায় কখনো পিছপা হননি আদনান। দুই ছেলে মেয়ের সংসারে আদনানই বড়। স্বপ্ন ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সরকারি চাকরি করবে পরিবারের বড় ছেলে৷ তবে সেই স্বপ্ন ধুলিস্মাত হয় যখন ঢাবিতে তার ফলাফল অনুত্তীর্ণ আসে।

আদনান বলেন, আমার হাত পায়ে সমস্যা। লিখতে গেলে কাঁপে। শরীরের ব্যালেন্স রাখতে পারিনা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কোনো সাহায্য পাইনি। ইবিতে আমাকে শ্রুতিলেখক দিয়ে লেখার সুযোগ দিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ পরীক্ষা ভালো হয়েছে। তবে ঢাবিতে পরীক্ষার সময় আমি নিজের বৃত্ত নিজেই ভরাট করেছি যার ফলে বেশীর ভাগ বৃত্ত বাইরে চলে যায়। আমার ধারণা পরীক্ষা ভালো হওয়ার পরও আমি ঢাবিতে উত্তীর্ণ হতে পারিনি হয়তো কম্পিউটারে খাতা দেখায়। যদি শিক্ষকরা নিজ হাতে দেখতো তবে হয়তো আজ আমাকে এখানে আসতেই হতোনা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন তিনি যেনো আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার খাতা না দেখিয়ে হাতে দেখায়।

আদনান আরও বলেন, সবকিছু আল্লাহার ইচ্ছাতেই। তিনি যদি চান ঢাবি নয় আমি ইবিতে পড়ব তবে তাতেও খুশি আমি।

আদনানের মা সাবিনা সুলতানা বলেন, মার কাছে সন্তানতো সন্তানই। অনেক কষ্ট করে আমরা এই ছেলেকে নিয়ে এগিয়েছি। প্রাইমারি লেভেল পর্যন্ত ওকে কোলে নিয়েই স্কুলে গিয়েছি। এক হাতে ব্যাগ ছিলো আরেক হাতে আদনান। আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিলো ওকে আমার যেভাবেই হোক মানুষ করতেই হবে। আমরা মা রা ছেলের অসুস্থতা থাকলেও সুস্থতাটাই দেখে। মা’ই হচ্ছে সন্তানের বড় শিক্ষক। একটা মা’ই সন্তানকে ফেলে দিতে পারে আবার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করতে পারে। সবুজ কানন স্কুলে পড়ার সময় আমি আট বছর তাকে কোলে নিয়ে স্কুলে গিয়েছি। আদনান ১৮ মাস বয়সে বসতে শিখেছে আর ৯ বছরে হাঁটা। ও ছোট বয়সে হাটতে পারতো না, নড়াচড়া করতে পারতো নাহ, কথাও বলতে পারতো না।

আমি মিউজিক বাজিয়ে নড়াচড়া করিয়েছি, মানুষের মধ্যে মিশতে শিখিয়েছি। আমি ১৮ বছর ধরে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছি সেখানে ওর বেঁড়ে ওঠা। সেখানে মেডামদের সামনেই সে বেঁড়ে উঠেছে। ওখানে প্রাইমারি লেভেল শেষ করে দিনমণি হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে। কলেজ জীবনে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে। ওর খুব সখ ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। তবে ওর হাতের সমস্যার কারণে খাতায় বৃত্ত ভরাট করার পরও তা হয়তো বাতিল হয়ে যায়। পরীক্ষার দেওয়ার পর থেকেই সে আফসোস করছিলো যে পরীক্ষা ভালো হলেও হয়তো ভাগ্যে নেই। তবে আমরা চেয়েছিলাম ঢাবির ভিসি বরাবর একটি আবেদন দিতে যাতে ওর খাতাটা হাতে দেখা হয়। তারপরও আমি চাই যে আমার ছেলের যদি কুষ্টিয়াতেও হয়ে যায় তাহলে আমার কাছেই থাকবে আমরা তাতেই খুশি। আদনানের সিট পড়েছিল অনুষদ ভবনের তিনতলায় এখানকার বিএনসিসি স্কাউটরা তাকে হলে পৌছে দিতে অনেক সাহায্য করেছে।