বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে জেগে ওঠা একটি দ্বীপ। প্রকৃতি যেন দ্বীপটিকে সাজিয়েছে তার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে। গুগল ম্যাপে যার নাম রয়েছে ‘হেয়ার আইল্যান্ড’। স্থানীয় কারো কাছে ‘চরহেয়ার’, কারও কাছে আবার ‘কলাগাছিয়া চর’ নামেও পরিচিত এই দ্বীপটি। দ্বীপটিতে আছে চোখজুড়ানো বালুকাময় দীর্ঘ সৈকত। সাগরের বিশাল জলরাশি। তটরেখায় লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি। সারি সারি ঝাউবন, আর এর শো শো শব্দ।
নয়নাভিরাম দ্বীপটির অবস্থান সাগরকন্যা খ্যাত জেলা পটুয়াখালীর সর্বদক্ষিণের সাগর সান্নিধ্যের নৈসর্গিক ভূখণ্ড রাঙ্গাবালী উপজেলা থেকে নৌপথে ১৫ কিলোমিটার দূরে। যাতায়াত মাধ্যম একমাত্র নৌপথ। ইঞ্জিন চালিত ট্রলার কিংবা স্পিডবোটে সেখানে পর্যটকরা আসে-যায়।

সে পথে যেতে বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর ধরে দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগুলোলেই প্রথম দেখা মিলবে ঘন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ‘চরতাপসি’। পূর্ব দিকে রয়েছে অপরূপ আরেকটি দ্বীপ, যার নাম ‘সোনারচর’। যেটি দেখতে অনেকটাই সুন্দরবনের মত। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে গেলেই দেখা মিলবে ডিমাকৃতিকর ‘হেয়ার আইল্যান্ড’। যেখানে ভ্রমণপিপাসুদের একবার পা পড়লেই বার বার আসতে মন চাইবে।

চারদিকে চোখজুড়ানো বালুকাময় সৈকত। লাল কাঁকড়ার দল। অতিথি পাখির কলকাকলি। সবুজ ঘন বনায়ন। এর মাঝে গাছের ঝরা পাতা‌ এমনভাবে বিছিয়ে আছে দেখলে মনে হবে ঝাউ পাতার কার্পেট দিয়ে আপনাকে কেউ স্বাগত জানাচ্ছে। বনায়নের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে আরও চোখে পড়বে নানা আকারের ছইলা, কেওড়া, বাইন, গোলপাতা, হারগুজি, তাম্বুরা কাটার ঝোপঝাড়। আর সেই ঝোপঝাড়ে দেখা মিলবে ঝাঁকে ঝাঁকে চেনা-অচেনা পাখি।
দ্বীপটিতে কাকডাকা ভোরে সূর্যোদয়, আর সাঁঝবেলায় সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য অবলকনের সুযোগ। এমন সব সৌন্দর্য পর্যটকদের কাছে এমনেতেই আকর্ষণীয়। সেই আকর্ষণ আরও বাড়াতে সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে ভ্রমণপিপাসুদের বিশ্রামের জন্য স্লিপিং চেয়ার, রঙিন ছাতা, এবং গাছে গাছে ঝুলন্ত দোলনাও দেওয়া হয়েছে হেয়ার আইল্যান্ডে। শুধু তাই নয়, ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য ডাস্টবিনও বসানো হয়েছে।
এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকরা বলছেন, থাইল্যান্ডের ফিফি আইল্যান্ড কিংবা বালি দ্বীপের মত করে সাজানো যায় এই হেয়ার আইল্যান্ডকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সেই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে হেয়ার আইল্যান্ড, সোনারচর, জাহাজমারা ও তুফানিয়া নামক চারটি পর্যটন স্পট নিয়ে পর্যটন জোন করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পর্যটকরা মনে করেন, পাশর্বর্তী পায়রা সমুদ্র বন্দর ও কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র থাকায় এখানকার পর্যটন সম্ভাবনাও বেড়েছে কয়েকগুণ।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক পর্যটক আকৃষ্ট করতে দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন উন্নয়নে ‘পায়রা বন্দর নগরী ও কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ পর্যটন ভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প এলাকায় বিমানবন্দর করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। পর্যটকরা বলছেন, এই প্রকল্প এলাকা থেকে রাঙ্গাবালীর পর্যটন স্পটগুলোতে আসা-যাওয়ার সুযোগ তৈরি হলে কুয়াকাটার পাশাপাশি এখানকারও পর্যটন সম্ভাবনাও বিকাশিত হবে। সে ক্ষেত্রে কুয়াকাটা এবং পায়রা বন্দর এলাকা থেকে নৌপথে রাঙ্গাবালী আসা-যাওয়ার জন্য সি-ট্রাক কিংবা শিপ চালু করা যেতে পারে; বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাঙ্গাবালীর পর্যটন উন্নয়নে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী আইয়ুব খান বলেন, ‘এ অঞ্চলটি পর্যটক বান্ধব। তাই পর্যটন উন্নয়নে এখানে অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে। সকলে এগিয়ে আসলে এখানকার পর্যটন সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের উন্নয়নের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও যদি এখানে হোটেল-মোটেল করে তাহলে এখানকার পর্যটন সম্ভাবনার বিকাশ ঘটবে বলে আমি মনে করি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ দ্বীপগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভ‚মি। পর্যটন জোন করে যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পর্যটকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হলে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্পট হবে। তখন এখানে দেশী পর্যটকরে পাশাপাশি বিদেশী পর্যটকরাও ছুঁটে আসবে।’ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘রাঙ্গাবালীর চারটি সৈকত নিয়ে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করা হলে দেশের পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে বলে মনে করছি। তাহলে এ অঞ্চলের মানুষও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে।’

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান জানান, ‘পর্যটক ও স্থানীয়দের জন্য চরহেয়ার (হেয়ার আইল্যান্ড), সোনারচর ও জাহাজমারায় তিনটি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। যেগুলোকে আধুনিকমানের রেস্ট হাউসে রূপান্তরিত করা হবে। যাতে দেশি এবং বিদেশী পর্যটকরাও এসে সেখানে রাত্রিযাপন করতে পারেন এবং দুর্যোগের সময় আশ্রয় নিতে পারেন।’