রাজধানীর উত্তরা এলাকায় রাজউকের পাঁচটি ১০ কাঠা এবং ছয়টি ২০ কাঠা আয়তনের মোট ১১টি প্লট একক দরে ৪০৩ কোটি ৯৬ লাখ ৬৯ হাজার ২১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গোপন সমঝোতায় অন্তত ১০০ কোটি টাকা কম মূল্যে প্লটগুলো বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।

প্রতিযোগিতামূলক দরে বিক্রি না হওয়ার কারণে সরকারের ১০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ রাজউকের কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট একক দরে বিক্রির বিধান নেই। তারপরও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কিছু কর্মকর্তার কোটি কোটি টাকা লুটপাটের সুযোগ অক্ষুণ্ন রাখতে দিনের পর দিন এমন অনিয়ম নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। একক দরে গোপন সমঝোতার প্রকৃত রহস্য উন্মোচনে এবার মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

উত্তরা এলাকার চার কাঠা আয়তনের একটি, ১০ কাঠা আয়তনের নয়টি, ২০ কাঠার ১৩টিসহ মোট ২৩টি প্লট নিলামে বিক্রি করে রাজউক। এর মধ্যে ১০ কাঠা আয়তনের পাঁচটি এবং ২০ কাঠা আয়তনের ছয়টিসহ মোট ১১টি প্লট বিক্রি করা হয় একক দরে।

সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিলাম কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদকের কমিশন। গত মাসের শেষ সপ্তাহে নেওয়া এমন সিদ্ধান্তের পর শিগগিরই অনুসন্ধান টিম গঠন করতে যাচ্ছে সংস্থাটি।

দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

এ বিষয়ে রাজউকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রাজউকের কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট একক দরে বিক্রির বিধান নেই। কিন্তু রাজউকের একটি সিন্ডিকেট অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে প্রতিযোগিতামূলক দর ছাড়াই একক দরে ১১টি প্লট বিক্রি করে দিয়েছে। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও দুদক তদন্ত করলে প্রকৃত রহস্য উন্মোচন হবে।

যদিও একক দরে প্লট বিক্রি ও সরকারের আর্থিক লোকসানের কথা সরাসরি অস্বীকার করেছেন নিলাম কমিটির আহ্বায়ক ও রাজউকের পরিচালক (অ্যাসেট ও ভূমি-১) মো. কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাজউকের প্লট বিক্রির ক্ষেত্রে ওপেন টেন্ডার মেথড (ওটিএম) পদ্ধতির অবলম্বন করা হয়। একক দরদাতাকে দেওয়ার সুযোগ নেই। বিষয়গুলো ফাইনাল হয়নি। প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় আছে। কম মূল্যে বিক্রির সুযোগ নেই, প্রশ্নই আসে না।

রাজউকের অপর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে প্লট বিক্রির ঘটনা আমার নজরে নেই। তবে, অনেককেই এককভাবে প্লট দেওয়া হচ্ছে, এটা সত্য। আসলে এ প্রথা বন্ধ হওয়া উচিত।

নিলামে ২৩টি প্লট ক্রয়ের জন্য ৫৭টি দরপত্র জমা পড়ে। ২৫ অক্টোবর দরদাতাদের উপস্থিতিতে দরপত্র খোলার পর দেখা যায় ১২টি প্লট নিলামে ক্রয়ের জন্য দুই থেকে সাতটি পর্যন্ত দরপত্র জমা হলেও ১১টি প্লটের বিপরীতে মাত্র একটি করে দরপত্র জমা পড়ে। এখানে বড় ঘাপলা হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজউক সূত্রে পাওয়া নথিপত্র বলছে, ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে নিলামে মোট ২৩টি প্লট বিক্রি হয়। এর মধ্যে ১২টি প্লট প্রতিযোগিতামূলক দরে প্রায় ৫৮৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকায় এবং ১১টি প্লট একক দরে প্রায় ৪০৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। উত্তরা এলাকার চার কাঠা আয়তনের একটি, ১০ কাঠা আয়তনের নয়টি, ২০ কাঠার ১৩টিসহ মোট ২৩টি প্লট নিলামে বিক্রি করে রাজউক। এর মধ্যে ১০ কাঠা আয়তনের পাঁচটি এবং ২০ কাঠা আয়তনের ছয়টিসহ মোট ১১টি প্লট বিক্রি করা হয় একক দরে।

নিলামের পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ওই বছরের ১৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত রাজউকের ১৩/২০২২তম বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হয়। সভায় আলোচনা শেষে একক দরদাতাদের নামে প্লট বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়।

নথিপত্রের তথ্যানুসারে, ঢাকা মহানগরীর উত্তরা (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব) আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক প্লট নিলামে বিক্রির বিষয়টি বোর্ড সভায় অনুমোদনের পর ২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নিলাম কমিটির সভায় দরপত্র আহ্বান, তফসিল অনুমোদন ও দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ওই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর চারটি পত্রিকায় রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞার স্বাক্ষরিত নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিতও হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উত্তরা ১১ ও ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁ জনপথ সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক এবং ১৬ ও ১৮ নম্বর সেক্টরের মোট ৪৫টি প্লট নিলামে বিক্রির তথ্য প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে মামলাজনিত কারণে ৩টি প্লটের নিলাম স্থগিত রাখা হয়।

নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের ১০ ও ২০ কাঠা আয়তনের নয়টি প্লট, যার প্রতিটির কাঠাপ্রতি ভিত্তিমূল্য ছয় কোটি এবং দুটির মূল্য এক কোটি ২৫ লাখ করে ধার্য করা হয়। ১১ ও ১৩ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁ জনপথ সড়কের ১০ কাঠা আয়তনের ১৩টি প্লট, যার প্রতিটির কাঠাপ্রতি ভিত্তিমূল্য ধরা হয় তিন কোটি ৫০ লাখ টাকা করে, ১৬ ও ১৮ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর অ্যাভিনিউ সড়কের ২০ কাঠা আয়তনের ২১টি প্লট, যার প্রতিটির কাঠাপ্রতি ভিত্তিমূল্য ধরা হয় এক কোটি ৫০ লাখ টাকা করে। বিজ্ঞপ্তি অনুসারে প্লট ক্রয়ের দরপত্র জমার শেষ তারিখ ছিল ২৫ অক্টোবর। ওইদিন পর্যন্ত মোট ১৮২টি দরপত্র বিক্রি হয়। নিলামে ২৩টি প্লট ক্রয়ের জন্য ৫৭টি দরপত্র জমা পড়ে। ২৫ অক্টোবর দরদাতাদের উপস্থিতিতে দরপত্র খোলার পর দেখা যায় ১২টি প্লট নিলামে ক্রয়ের জন্য দুই থেকে সাতটি পর্যন্ত দরপত্র জমা হলেও ১১টি প্লটের বিপরীতে মাত্র একটি করে দরপত্র জমা পড়ে। এখানে বড় ঘাপলা হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, রাজউকের নিলাম কমিটি ওই ১১টি প্লট বিক্রির জন্য পুনরায় নিলাম দরপত্র আহ্বান না করে একক দরদাতার নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

রাজউক এবার যে নিলাম করেছে, তারা আগে গোপনে প্লটের ক্রেতা ঠিক করে দরও ঠিক করে বিক্রি করেছে। যে ১১টি প্লট গোপন সমঝোতায় বিক্রি হয়েছে এসব প্লটের দরপত্র দাখিলকারীদের কাছ থেকে অবশ্যই কোটি কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে।

অন্যদিকে নিলাম কমিটি একক দরে প্লট বিক্রির সুপারিশে বলেছে, যেহেতু চারটি পত্রিকায় সব প্লটের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। নিলামে বিক্রির দরপত্র ক্রয় ও দাখিলের আগে প্লট পরিদর্শন করে প্লটের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে অবগত ছিলেন মর্মে ধরা যায় এবং একক দাখিলকারী চাহিত ভিত্তিমূল্য থেকে কম মূল্য দাখিল করেননি, সমান ভিত্তিমূল্য দাখিল করা হয়েছে। তাই একক দর দাখিলকারীকে সম্পূর্ণ অর্থ প্রাপ্তি ও অন্যান্য বিধি-বিধানের সাপেক্ষে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা যেতে পারে। এরপর নিলামের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত রাজউকের ১৩/২০২২তম বোর্ড সভায় উপস্থাপন করা হয়। সেখানে আলোচনা শেষে একক দরদাতাদের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

নিলামে একক দরে প্লট বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের এক কর্মকর্তা বলেন, রাজউকের কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর যদি মাত্র একটি দরপত্র দাখিল হয় তাহলে নিয়ম হচ্ছে পুনরায় তিনবার নিলামের ব্যবস্থা করা। কিন্তু রাজউক এবার যে নিলাম করেছে, তারা আগে গোপনে প্লটের ক্রেতা ঠিক করে দরও ঠিক করে বিক্রি করেছে। যে ১১টি প্লট গোপন সমঝোতায় বিক্রি হয়েছে এসব প্লটের দরপত্র দাখিলকারীদের কাছ থেকে অবশ্যই কোটি কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে।

তিনি বলেন, রাজউকের উত্তরা এলাকার বাণিজ্যিক প্লটের প্রতি কাঠার মূল্য চার থেকে ১০ কোটি টাকা। অথচ সেখানে রাজউক প্লট নিলামের ভিত্তিমূল্য ধার্য করেছিল এক কোটি ২৫ লাখ থেকে ছয় কোটি টাকা, যা বাজারমূল্য থেকে অনেক কম। রাজউক কর্মকর্তারা প্লট ক্রয়ে আগ্রহীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভিত্তিমূল্যের কাছাকাছি দরে বিক্রি করেছে। প্লটগুলো প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিক্রি হলে আরও বেশি মূল্য পাওয়া যেত।

উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের প্রতি কাঠার ভিত্তিমূল্য ধরা হয়েছিল ছয় কোটি টাকা। ওই সড়কের ১০ কাঠা আয়তনের ৯৫ নম্বর প্লটটি ৬২ কোটি ১৭ লাখ ৫৬ হাজার ২১০ টাকায় মো. মজিবুর রহমানের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ সূত্রে আরও জানা যায়, একক দরে বিক্রি করা ১১টি প্লটের মধ্যে ১৩ নম্বর সেক্টরের জনপথ সড়কের ১০ কাঠা আয়তনের চারটি প্লট রয়েছে। এর মধ্যে ২৭ নম্বর প্লটটি ৩৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় মোনালিসা সিরামিক কোম্পানি, ৪৫ নম্বর প্লটটি ৩৫ কোটি ৫০ লাখে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ৪৯ নম্বর প্লটটি ৪০ কোটি ৫ লাখ ১৩ হাজারে ইয়েস্টার জিন্স লিমিটেড এবং ৭৫ নম্বর প্লটটি ৩৫ কোটিতে এমএম অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, ১৬ ও ১৮ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর অ্যাভিনিউ সড়কের প্রতি কাঠার ভিত্তিমূল্য ধার্য ছিল এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। সেখানকার প্রতিটি প্লট ২০ কাঠা আয়তনের। এর মধ্যে ১ নম্বর প্লটটি একক দরদাতা হিসেবে ৪১ কোটি ৩০ লাখে ডেল্টা ফার্মা লিমিটেড, ১৩ নম্বর প্লটটি ৩৪ কোটি ২০ লাখে হেলথ কেয়ার ফরমুলেশন লিমিটেড, ১৮ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর অ্যাভিনিউ সড়কের ২ নম্বর প্লটটি ৩৭ কোটিতে টু বিল্ডার্স লিমিটেড, ১০ নম্বর প্লটটি ৩১ কোটিতে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ১৮ নম্বর প্লটটি ৩১ কোটিতে সেলিনা অ্যাপারেল লিমিটেড, ২০ নম্বর প্লটটি ৩১ কোটি ৫০ লাখে ইনডেক্স পোলট্রি (প্রা.) লিমিটেড-কে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের প্রতি কাঠার ভিত্তিমূল্য ধরা হয়েছিল ছয় কোটি টাকা। ওই সড়কের ১০ কাঠা আয়তনের ৯৫ নম্বর প্লটটি ৬২ কোটি ১৭ লাখ ৫৬ হাজার ২১০ টাকায় মো. মজিবুর রহমানের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।