বদরুল হায়দারের সকালের শুরুটা হয় খামারের কেঁচো এবং খামার পরিচর্যার মাধ্যমে। কাঁচা গোবর থেকে কেঁচোর মাধ্যমে তৈরি করেন ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার। নিজে জেমন তৈরি করেন সার তেমনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে তরুন উদ্যোক্তাদের উদ্ভোদ্ধ করেন। প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তাদের কৃষি উদ্যোক্তা তৈরিতে ভুমিকা রাখেন। বলছিলাম পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার চৌঠাইমহল গ্রামের সফল উদ্যোক্তা বদরুল হায়দার বেপারির কথা। জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা এবং মাটির হারানো গুনাগুন ফিরে পেতে ভার্মি কম্পোস্ট উল্লেখযোগ্য কাজ করে। সরকারি সহায়তায় কেচোঁ সার ব্যাবহারে দেশের কৃষিতে বিপ্লব ঘটতে পারে।

সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিনিয়তই যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে কৃষিব্যবস্থা। সেই সঙ্গে জমিতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারে কমছে মাটির উর্বরতা। ফসলের উৎপাদন বাড়াতে প্রতিদিনই বাড়ছে রাসায়নিক সারের ব্যবহার। মাটির উর্বরতা রক্ষায় ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার অন্যতম ভুমিকা পালন করে। যা ব্যবহার করে সল্প খরচেই অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব। কেঁচো সার উৎপাদনের জন্য স্বীকুতি স্বরুপ বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী পরিষদ কতৃক পুরস্কৃত করা হয়। বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ১৪২৫ সহ ২০২০ সালের ২৭ জুলাই কৃষি মন্ত্রনালয়ের আয়োজনে প্রথমবারের মতো কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) সন্মাননা পেয়েছেন তিনি। রাজধানীর ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিক ভাবে সেদিন তার হাতে এ সন্মাননা তুলে দেওয়া হয়। তার সংগ্রহে রয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের পুরষ্কার। দেখা যায়, প্রতিনিয়তই যান্ত্রিকিকরন হচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা। সাথে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারে কমছে মাটির উর্বরতা। ফসলের উৎপাদন বাড়াতে প্রতিদিনই বাড়ছে রাসায়নিক সারের ব্যবহার। মাটির উর্বরতা রক্ষায় ভার্মি কম্পোষ্ট বা কেঁচো সার অন্যতম ভুমিকা পালন করে। যা ব্যবহার করে সল্প খরচেই অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব।

জাগো এগ্রো সলিউশন এর স্বত্বাধিকারী বদরুল হায়দার ব্যাপারী বলেন, ছোট থেকে আমার একটা স্বপ্ন অনেক মানুষকে নিয়ে কাজ করার কিন্তু লেখাপড়া শেষ করে স্থানীয় রাজনীতিও ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পরি। এরপর আর পরে তিনি ২০১২ সালের শেষের দিকে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় দেখি কেচোঁ সারে ভাগ্য খুললো মানিক বর্মার। কেচোঁ সার বিষয়ে মানিক বর্মার সঙ্গে যোগাযোগ করি জানি এবং উপজেলা কৃষি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমি কিছুটা ধারণা নি। তখন আমার মনে হলো কেচোঁ সার একদিকে আমার স্মার্ট কর্মসংস্থান হতে পারে। আমি যে ছোট বেলা থেকে ভাবনাটা ছিলো বৃহত্ত একটি কমিউনিটিকে সাপর্ট দিতে পারবো এবং কৃষিতে রাসয়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব আমদানি কমিয়ে আনা সম্ভব। এখানে কৃষি অর্থনীতিতে একটি সাপর্টের জায়গা হবে এই ধারণা নিয়ে ভার্মি কম্পোষ্ট বা কেঁচো সার সল্প পরিসরে কাজ শুরু করেন বদরুল।

তিনি আরো জানান, শুরুতে যে জায়গাটিতে একটি হোচঁট খাই কৃষকরা উৎপাদন করবে কিন্তু তারা নিজের জমিতে ব্যবহার করবে না। পরে আমি দু’বছর আমার ইউনিয়েনে কাজ করার পর কেচোঁ বাদে অনান্য সার বিক্রি হয় কিন্তু আমার কেচোঁ সার কেহ নিতে চায় না। কি ভাবে শুরু করেছেন এসম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, শুরুটা এবং পরবর্তী একটা লম্বা সময় ছিলো প্রচন্ড রকমের অসহযোগীতা আমি যেনো একটি নিন্দানীয় কর্ম করছি। সমাজে অচ্ছুত একটা কাজ করছি, মানুষ আমাকে পাগল বলত সবাই এটিকে খারাপ দৃষ্টিতে নিয়েছে। এই খামারে মাসে ১৫ টন সার উৎপাদন হয়। এক কথায় যদি বলি যে একটি লম্বা যুদ্ধের পর এক পর্যায়ে সরকারের স্বীকৃতি মিলেছে, বিক্রি বেড়েছে এখন আমি তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি বিআরডিসি কে সার দেই।

২ কেজি কেঁচো কিনে শুরু করা সেই কাজের বর্তমান অবস্থান বর্তমানে ৬ শতক জায়গায় বদরুলের “জাগো এগ্রো সলিউশন‍”। যেখান থেকে বস্তা প্রতি ৭৫০-৮০০ টাকায় সার বিভিন্নস্থানে বিক্রি করেন তিনি। ৭৪ টি রিং এ সেখান থেকে রিং পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রতি বছর উৎপাদিত ১৫০ টন ভার্মি কম্পোষ্ট বা কেঁচো সার বিক্রি করে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা আয় হয় বদরুলের। এই সার বিক্রি করে নিজে সাবলম্বী হবার পাশাপাশি নিজ এলাকায় করেছেন আত্মকর্মসংস্থানের মতো জায়গা। বর্তমানে জাগো এগ্রো সলিউশনে ৫ জন স্থায়ী নারী কর্মচারী কাজ করলেও ৩ জন পুরুষ কর্মচারী অস্থায়ীভাবে প্রয়োজনানুসারে কাজ করেন।

যেভাবে উৎপাদিত হয় ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সারঃ প্রাথমিক পর্যায়ে স্থানীয় শ্রমিকদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা গোবর রোদে শুকিয়ে ভেঙে গ্যাস বের করে দেওয়া হয়। ১০/১২ দিন পর কলাগাছ/কচুরিপানার কুচি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় সেই গোবর। এর মধ্যে সার উৎপাদনে কাজ শুরু করে কেঁচো। দেড়/দুই মাস পর সেখান থেকে কেঁচো বের করে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় নেট পদ্ধতি। সেখান থেকে চালনিতে পরিশোধন শেষে প্যাকেজিং হয়ে বাজারজাত হয় সার।

নারী শ্রমিক কল্পনা মিস্ত্রী বলেন, বদরুলের খামার শুরু হওয়ার পর থেকে কাজ করছেন তিনি। সারাদিন বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে একটু একটু করে সার তৈরি করতে কেঁচোকে সহযোগিতা করেন তিনি। সার উৎপাদন থেকে প্যাকেটজাত হয়ে বিক্রি পর্যন্ত সারাদিন বিভিন্ন কাজ তিনিই করেন। আগে ঘরে বসে থাকার চেয়ে এ কাজ করে অনেকটা স্বাবলম্বী হয়েছি সংসারে এখন আর টানপড়ন থাকে না। কিছুদিন আগে ছেলের ফরম ফিলাপের চার হাজার পাচশত টাকা দিয়েছি এখান থেকে আয় করে। একই গ্রামের রুহুল আমিন শেখ নামের এক শ্রমিক জানান, আমি আগে কৃষি কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এই ২-৩ বছর ধরে আমার চাচা একটি জৈব সার কারখানা করছে এখানে কাজ করি। আগে যে কাজ করে সংসার চালাতাম এখন তার চেয়ে ভালো আছি।

এ বিষয়ে নাজিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ইসরাতুন্নেছা এশা বলেন, দেশের জনসংখ্যা বাড়ায় কৃষি উৎপাদন বেড়েছে কিন্তু জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বাড়তি জনসংখ্যার জন্য বাড়তি খাদ্য দরকার। বাড়তি খাদ্য যোগানের জন্য মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা। মাটির স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হচ্ছে শুধুমাত্র রাসয়নিক সার ব্যবহারে। এই মূহুর্তে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা ও গুণাগুণ বৃদ্ধি করা। আর এই মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রধান উপকরন হচ্ছে জৈব সার। বর্তমান প্রচলিত জৈব সারের মধ্যে সব চেয়ে ভালো হলো ভার্মি কম্পোষ্ট বা কেঁচো সার। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা বিভিন্ন ভাবে প্রদর্শনি দিয়ে থাকি। বর্তমানে আমাদের নাজিরপুরে প্রায় পাচঁশতাধিক র্ভামি কম্পোষ্ট বা কেঁচো সার স্থাপিত হয়েছে। দিন দিন এর সংখ্যা বেড়ে চলছে। ভার্মি কম্পোষ্ট উৎপাদনে খরচের চেয়ে উৎপাদন বেশি। এতে করে মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে সঙ্গে কৃষকেরা লাভবান হচ্ছে এবং র্ভামি কম্পোষ্ট ব্যবহারও বাড়ছে। ভার্মি কম্পোষ্ট ব্যবহারে আমাদের কৃষি চাহিদা সহজে পূরন হবে। মাটির স্বাস্থ্য যদি আমরা না রক্ষা করতে পারি তাহলে আমাদের কৃষি মুখ থুপড়ে যাবে। তখন সমস্থ দেশ অচল হয়ে যাবে কারন কৃমিই আমাদের একমাত্র সম্বাভনা যা দেশকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

বার্তা বাজার/জে আই