আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৬০ আসনে এককভাবে নির্বাচনের জন্য চূড়ান্ত প্রার্থী ঠিক করেছে জামায়াত। যদিও নির্বাচন ঘনিষ্ট সময় এগিয়ে আসলে এই সংখ্যার কম বেশী হওয়ার সম্ভাবন আছে তবে প্রচারণার ক্ষেত্রে ৩০০ আসনেই নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে মর্মে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

দলটির ধারনা, ক্ষমতাসীন আওয়ামীলিগ এর শাষন আমলে বিগত প্রায় ১৫ বছরে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের ফাঁসি কার্যকরের ঘটনা সহ নানাবিধ রাজনৈতিক প্রহসন মূলক আচরণের ফলে, দলটির জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।

জামায়াতের করা নিজস্ব কিছু জরিপের ফলাফলে এবং সাধারণ জনগণের জামায়াতের প্রতি প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে, দলটির সিনিয়র হাই কমান্ডের দাবী দেশের মোট ভোটারের ২৭ শতাংশ ভোট ব্যাংক দখলে নিয়ে একক নির্বাচনে অংশগ্রহনের মাধ্যমে নূন্যতম ৬০ থেকে ৭০টি আসন জিতে নেয়ার সক্ষমতা রয়েছে তাদের। এছাড়াও তাদের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, বিগত ১৪ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশী সময় ধরে যে নতুন সংখ্যক তরুন ভোটার বিশৃঙ্খল নির্বাচনী পরিস্থিতির কারনে ভোট প্রদান করতে পারে নি, তাদের একটি বড় অংশ জামায়াতে ইসলামীকে ভোট প্রদান করবে।

প্রসঙ্গত দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের টানা হেঁচড়ায় কোন রূপ রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কোন ঠাঁসা চাপে না থেকে একক ভাবে নিজেরাই মাঠে নামার জন্য চুড়ান্ত প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করেছে দলটি। সূত্র সংম্লিষ্ট তথ্যের বরাতে জানা যায়, খুব শীঘ্রই বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণার মহড়া শুরু করবে তারা। তবে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে প্রকাশ্য অনীহা প্রকাশ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দাবীতে সরব আন্দোলনে মাঠে নামলেও বিএনপির শীর্ষ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আটকের পর জোট ভিত্তিক আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং বেগম জিয়া বন্দি অবস্থায় জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়ায় আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে থাকাও বিপজ্জনক মনে করছে দলটি।

জামায়াতের নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, সরকারের সঙ্গে পর্দার আড়ালে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে দলটির হাইকমান্ডের। সর্বশেষ গত মাসের এক বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে একটি আপোষ প্রস্তাব দেয়া হয় জামায়াতকে। যা গ্রহণ করলে জামায়াতের তৃণমূলে ভাঙন তৈরি হতে পারে মর্মে দলীয় পর্যবেক্ষনে উঠে এসেছে।

দলের হাইকমান্ডের দাবী, এই মুহুর্তে সরকারের সঙ্গে আপোষ মানে রাজনীতি এবং ইসলামী আদর্শ— এ দুইয়ের মধ্যে আভ্যন্তরীন সংঘর্ষ তৈরি করা। তাই এখনি সরকারের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়ে যেতে নারাজ দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। যদিও বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জামায়াত এবং সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা বৈঠকে ‘ডোন্ট ডিসটার্ব’ নীতিতে রাজনৈতিক ভাবে নিষ্কিৃয় থাকার কথা বিভিন্ন অঙ্গন থেকে শোনা গেছে,তবে তা তিন বছরের বেশী দীর্ঘ হয়নি মর্মেও জানা যায়।

জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের দাবী, দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমির মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে প্রথমিক সমঝোতা ভঙ্গ করে সরকার। এদিকে জামায়াতের অন্য একাংশের দাবী এমন যে, সরকার বিএনপির বিকল্প রূপে জামায়াতকে ভোটে টানতেই শীর্ষনেতাদের গ্রেপ্তার করেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে আসা প্রস্তাবের ব্যাপারে হাই কমান্ডের মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে, তবুও বিষয়টিকে আদর্শিক ভাবে শীর্ষ নেতাদের রাজনৈতিক সফলতা হিসেবেই দেখছে দলটি।

আসন্ন নির্বাচনে জামায়াতের প্রতি দুই দলের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। এবং সবাই জামায়াতকে নিজেদের ঘরে টানতে চাচ্ছে মর্মে ধারনা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশ্লেষকদের মতে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যাওয়া বিগত নির্বাচনে জামায়াতকে ঘোষিত ২৪টি আসনে ধানের শিষ প্রতীক দেয়া হয়। একই সাথে ঐক্যফ্রন্টকে দেয়া হয় ২৩টি আসন।

বিগত নির্বাচনে রাজনৈতিক ভরাডুবির পর দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক বোদ্ধাদের সন্দেহ ছিলো যে, বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনী ভরাডুবির বিষয়টা পুরোপুরি আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। যার পেছনে ড. কামাল এবং মির্জা ফখরুলের ভূমিকা সন্দেহতীত ভাবে পরিদৃষ্ট হয়। ঐক্য ফ্রন্ট ভেঙ্গে যাওয়া এবং বিএনপির ভরাডুবি নিয়ে আভ্যন্তরীন শরীকদের কাছে দীর্ঘদিন তোপের মুখে ছিলেন মির্জা ফখরুল এমন ধারনা করছেন কেউ কেউ।

তবে, জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির পর বিএনপি থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে অসন্তোষে ভোগা জামায়েত বিগত নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে জামানত বাজেয়াপ্ত ভরাডুবির পর থেকেই ‘একলা চলো’ নীতিতে রাজনৈতিক অনড় ভূমিকায় রয়েছে। যদিও সম্প্রতি বিএনপির সরকার পতনের একদফায় আকাত্নতা প্রকাশ করেছে জামায়ত তবে এটি কোন দলবদ্ধ বা জোটবদ্ধ হবার ইঙ্গিত নয় মর্মে জানেয়েছে দলীয় সূত্র।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ঠাকুরগাঁওয়ের এক সমাবেশে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুখে মুখে জামায়াত বিরোধিতার ধুয়া তুললেও সরকারের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ এখন স্পষ্ট’। এর এক দিন পর মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের পালটা জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামী বিএনপির ‘বি টিম’, এটা দেশের সচেতন মানুষ সবাই জানে।’

উভয়ের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম জানান, ‘বর্তমান স্বৈরশাসকের’ বিরুদ্ধেও জামায়াত নিয়মতান্ত্রিভাবে রাজপথে আন্দোলন করে যাচ্ছে।
গত ১৫ বছরে জামায়াত সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত এবং মজলুম। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেয়ার পর বর্তমান আমিরে জামায়াত, নায়েবে আমির, সেক্রেটারি জেনারেল, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলসহ কেন্দ্রীয় নেতাদেরও কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী কোনো ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচার ও জালেমের সঙ্গে আঁতাত, সমঝোতা বা যোগাযোগ করে কখনো রাজনীতি করে না। করার প্রশ্নই আসে না।

জামায়াতে ইসলামীর সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর স্থায়ী কমিটির একটি অংশ এবং দলটিতে যারা বাম আদর্শে বিশ্বাসী, তারা জামায়াতে ইসলামীকে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। তারা এও মনে করছে, শুধু জামায়াত নয়, বিএনপির একটি অংশ খালেদা জিয়াকেও নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনে থাকা বিপজ্জনক বিধায়, এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এককভাবে ভোটের মাঠে পূর্ন শক্তি সঞ্চয় করে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়ত।

 

ই.এক্স/ও.আর/বার্তা বাজার