সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নির্বাহী সদস্য ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, ‘আমাদের এখানে নির্বাচন হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার স্টাইলে। দেশটির একটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র দখল করে রেখেছে। আমাদের এখানেও একটি গোষ্ঠী রাষ্ট্র দখল করে ফেলেছে। এই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বাইরে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। চায়না, রাশিয়া, ইরান কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতেও কিন্তু নির্বাচন হয়। তবে এই দেশগুলোতে যুগের পর যুগ ধরে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীই নির্বাচিত হচ্ছে। এই দেশগুলোর মতোই আমাদের এখানেও নির্বাচন নির্বাচন খেলা চলছে।’

বুধবার (১৯ জুলাই) পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘বিজয়ীদের তথ্যের বিশ্লেষণ ও নির্বাচন মূল্যায়ন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

গত ২৫ মে থেকে ২১ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ীদের তথ্য বিশ্লেষণ, উপস্থাপন ও সার্বিক নির্বাচন মূল্যায়ন তুলে ধরতে অনলাইনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।

শাহদীন মালিক বলেন, ‘মেয়রের পদ হলো সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহীর পদ। কিন্তু প্রচলিত আইনে তাদের ব্যবসা করতে বাধা নেই। এটি করতে হবে। না হলে ডিসি, এসপি, মন্ত্রী বেচারারা কী দোষ করেছে? বর্তমানে মেয়র হওয়া মানেই টাকা উপার্জনের পথ সুগম হওয়া।’

সুশীল সমাজের এই সদস্য বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রার্থীরা হলফনামা জমা দিলেও তার সত্যতা যাচাই-বাছাই করা হয় না। এটি যাচাইয়ের সুযোগও নেই। হলফনামা জমা দিতে হয়, তাই দেয়। এটিকে অর্থবহ না করেই নির্বাচন-নির্বাচন খেলা চলছে।’

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন হলো বিকল্প থেকে বেছে নেওয়ার ক্ষমতা, অধিকার ও সুযোগ। তাই যেখানে বিকল্প থাকে না, সেখানে নির্বাচনও হয় না। তবে বিকল্প হতে হবে যথার্থ। যেমন, সেদ্ধ পানি মিনারেল ওয়াটারের বিকল্প হতে পারে, কারণ দুটোকেই নিরাপদ বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু ট্যাপের পানি এর কোনোটিরই বিকল্প নয়, তাই এ ক্ষেত্রে ‘নির্বাচনে’রও সুযোগ থাকে না। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটির তথাকথিত নির্বাচনে মেয়র পদে, রূপক অর্থে, সেদ্ধ/মিনারেল ওয়াটারের বিপরীতে ট্যাপের পানি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল, যার ফলে এসব ক্ষেত্রে ভোটারদের সামনে কোনো যথার্থ বিকল্প ছিল না। উপরন্তু বরিশালে সহিংসতার অভিযোগে ইসলামী আন্দোলনের সরে দাঁড়ানোর ফলে সিলেট ও রাজশাহী সিটির নির্বাচন অনেকটা অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়।’

বদিউল আলম বলেন, ‘এই পাঁচটি সিটিতে মেয়র পদে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলা কোনোভাবেই যৌক্তিক হবে না। বরং এগুলোকে সর্বোচ্চ ভোটাভুটির বহুলাংশে শান্তিপূর্ণ অনুশীলন বলাই সমীচীন।’

সুজন-চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর সিকান্দার খান বলেন, ‘দেশে নির্বাচন-নির্বাচন খেলা বহুদিন ধরেই চলছে। রাজনীতিবিদদের মুখে উচ্চারিত ‘খেলা হবে, খেলা হবে’ স্লোগান এটিই প্রমাণ করে। আমাদের এই ‘খেলা’ থেকে বেরুতে হবে। না হলে নির্বাচন অর্থবহ হবে না। নির্বাচনকে অর্থবহ করতে হবে। নির্বাচনকে অর্থবহ করে তোলা নাগরিক হিসেবে আমাদের সকলের দায়িত্ব।’

নির্বাচনে বিজয়ীদের তথ্য বিশ্লেষণ, উপস্থাপন ও সার্বিক নির্বাচন মূল্যায়ন তুলে ধরে সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ‘সাধারণত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট পড়ার হার বেশি থাকে। তবে এবারের নির্বাচনে তেমনটি দেখা যায়নি। নির্বাচনের আগে থেকে ধারণা করা হচ্ছিলো যে, যেহেতু সকল দলের অংশগ্রহণে এই নির্বাচন হচ্ছে না, সেকারণে ভোট পড়ার হার কম হতে পারে। হয়েছেও তাই। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবারে ভোট পড়েছে ৪৮.৭৫%; ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৫৭.০২%। খুলনার নির্বাচনে এবারে ভোট পড়েছে ৪৭.৮৫%; ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৬২.১৯%। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবারে ভোট পড়েছে ৫১.৪৬%; ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৬৪.০০%। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবারে ভোট পড়েছে ৪৬.০০%; ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৬২.২৮%। রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবারে ভোট পড়েছে ৫৬.২০%; ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৭৮.৮৬%।’

দিলীপ কুমার বলেন, ‘বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় ধারণা করা হচ্ছিল যে, মেয়র পদের নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। চারটি সিটিতে এই ধারণা সত্যি হলেও গাজীপুরের নির্বাচনটি ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বিরোধ এবং বিকল্প প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া বর্ষীয়ান রাজনীতিক অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান হেরে গিয়েছেন।’

সুজনের সমন্বয়কারী বলেন, ‘কাউন্সিলর প্রার্থীদের নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয় না। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থন দিয়ে থাকে। এবারের নির্বাচনে কোনো কোনো দলের সমর্থিত প্রার্থী থাকলেও, অনেক দল প্রকাশ্যে প্রার্থীদের সমর্থন দেয়নি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যে সকল নেতা-কর্মী নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’

বার্তা বাজার/জে আই