যতই দিন যাচ্ছে, ততই দেশে নিরব ঘাতক ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিবছর দেশে গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত হচ্ছে। এই আক্রান্তদের অধিকাংশই পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে শেষ পর্যন্ত মারা যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গড়ে প্রতিদিন ৪৫৮ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। আক্রান্তদের মধ্যে গড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৩১৯ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগীর তুলনায় চিকিৎসা ব্যবস্থা একেবারেই কম হওয়ায় ঠেকানো যাচ্ছে না আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল।
৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যানসার দিবস উপলক্ষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৮৫টি দেশের ক্যানসার পরিস্থিতির অনুমিত পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। সেই পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বজুড়ে ক্যানসারের বোঝা বড় হচ্ছে। তাতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। এমনকি এই বোঝায় মৃত্যুর মিছিল দ্বিগুন হওয়ার আশঙ্কাও করেছে সংস্থাটি।
সংস্থাটি বলছে, ৩২ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এসব ক্যান্সারে দেশে আক্রান্ত রোগী প্রায় সাড়ে তিন লাখ। শুধু গেল বছরে ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৫৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন এই মরণব্যাধি ক্যানসারে। অথচ এসব মানুষদের চিকিৎসার জন্য মাত্র ২২টি চিকিৎসাকেন্দ্র আছে সারাদেশে। যার সিংহভাগ আবার রাজধানী ঢাকায়। ফলে চিকিৎসা ব্যয়সহ নানান কারণে কুলিয়ে উঠতে না পেরে বছরে ক্যানসারে মারা যাচ্ছেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জন। বর্তমানে মৃত রোগীদের হিসাব বাদেও দেশে ক্যান্সার রোগী আছে সংখ্যা ৩ লাখ ৪৬ হাজারের কিছু বেশি। তবে দেশীয় চিকিৎসকদের ধারণা, ক্যান্সার শরীরে আছে কিন্তু এখনও সেভাবে প্রকাশ পায়নি এমন রোগীর সংখ্যা ১৫-২০ লাখের মতো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যান্সারবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইএআরসি) বলছে, তামাক ব্যবহার, অ্যালকোহল সেবন, স্থূলতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে ২০৫০ সালের মধ্যে নতুন করে ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে কম আয়ের দেশে। দরিদ্র দেশগুলোতে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেড়ে দ্বিগুণ হতে পারে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
সংস্থাটি বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ৩৫ মিলিয়নে দাঁড়াতে পারে, যা ২০২২ সালের চেয়ে অন্তত ৭৭ শতাংশ বেশি হবে।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) এর তথ্য বলছে, দেশে ক্যান্সারের রোগীদের মধ্যে প্রধান পাঁচটি হলো- খাদ্যনালি, ঠোঁট ও মুখ, ফুসফুস, স্তন ও জরায়ু ক্যানসার। পুরুষের ক্ষেত্রে খাদ্যনালির ক্যানসার বেশি, আর নারীর ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসার বেশি। তবে মৃত্যু বেশি হচ্ছে খাদ্যনালির ক্যানসারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি করে ক্যানসার সেন্টার থাকা দরকার। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। মানসম্পন্ন চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে ১৭০টি ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা দরকার। কিন্তু আছে মাত্র ২২টি। তার বেশিরভাগই রাজধানী ঢাকায়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্য বলছে-দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন রোগীর চিকিৎসায় গড়ে ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৮৪০ টাকা পকেট থেকে খরচ করতে হয়। এই খরচ জনপ্রতি সর্বনিম্ন ৮১ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্তও হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ওষুধপত্র কিনতে। ক্যান্সারের প্রাথমিক স্তরে গড়ে চিকিৎসা খরচ ৩ লাখ ৩১ হাজার ২৪৩ টাকা। দ্বিতীয় স্তরে গড় খরচ ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৫ টাকা। তবে জেলা-উপজেলায় চিকিৎসা কেন্দ্র না থাকায় এই ব্যয়ভার অধিকহারে বাড়ছে।
নোয়াখালীর সুবর্ণচর থেকে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত এক নারী চিকিৎসার জন্য এসেছেন ঢাকার মহাখালীতে। তিনি প্রথমে চট্টগ্রামে মেডিকেলে সার্জারি ও কেমোথেরাপি নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে রেডিওথেরাপি না থাকায় ঢাকায় আসেন। হাসপাতাল থেকে ওই নারীকে রাজধানীর জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঢাকায় এসে দেখেন তার মতো হাজার হাজার রোগী অপেক্ষায় আছেন রেডিওথেরাপীর। প্রায় ১৫ দিন আবাসিক হোটেলে অবস্থান নিয়ে তিন মাস পর মে মাসের একটা সিরিয়াল তিনি পেয়েছেন। অর্থাৎ- ওই নারীকে রেডিওথেরাপি নেওয়ার জন্য আরও তিনমাস অপেক্ষা করতে হবে। ততোদিন এই রোগের কি অবস্থা হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তার মতো অন্যরা।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নাজিম উদ্দিন মোল্লা বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র হচ্ছে রেডিওথেরাপি মেশিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি মেশিন দরকার। সে হিসাবে আমাদের ১৭ কোটি মানুষের জন্য ১৭০টি মেশিন থাকা দরকার। আর চিকিৎসাসেবা সহজ করতে প্রয়োজন ২০০টি মেশিন।
তবে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে আছে মাত্র ২০টি মেশিন। এর অর্ধেকের বেশি আবার নষ্ট। বিএসএমএমইউতে একটি মেশিন আছে। সব সময় সচল থাকে না, মাঝেমধ্যে নষ্টও হয়ে যায়। আরেকটি মেশিন আনার প্রক্রিয়া চলছে, তবে কখন আসে, ঠিক নেই। ফলে রোগীরা সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে আরও ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ওষুধের খরচ অনেক বেশি। তবে আগের চেয়ে কিছু কমেছে। আগে যেখানে ৩০ হাজার লাগতো, সেখানে এখন ১০ হাজার লাগছে। তবে কাঁচামাল দেশে তৈরি করা গেলে আরো খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। রোগীর খরচ না কমানো গেলে চিকিৎসাসেবায় বৈষম্য হবে, এটা স্বাভাবিক।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের অভাবও আরেকটি বড় উদ্বেগের কারণ বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। দেশে মোট ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ তিন শর বেশি হবে না। তাদের পক্ষে এত বেশি রোগীর চিকিৎসা করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। তবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠা সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বার্তা বাজার/জে আই