শিল্প মানেই সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। কাজেই তর্কে কোন সৌন্দর্য নেই। তাই এটি শিল্প নয়। বিতর্ক একটি শিল্প। সৌন্দর্যমন্ডিত, পরিশীলিত, যুক্তিপূর্ণ তর্কই হচ্ছে বিতর্ক। ইংরেজি প্রতিশব্দ “Debate” যার আভিধানিক অর্থ তর্কাতর্কি, বাদানুবাদ, বাদ- প্রতিবাদ, বাগবিতণ্ডা ইত্যাদি। বিতর্ক শব্দটিকে আমরা বিশ্লেষণ করলে পাই “বি” যার অর্থ বিশেষ এবং “তর্ক” যার অর্থ বাদানুবাদ।

বহু প্রাচীনকালে গ্রিসের সফিস্ট্রিদের মাঝে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিতর্কের চর্চা শুরু হয়েছিল। ধারণা করা হয় খৃষ্টপূর্ব ৪৮৯ সালে গ্রীসের সোফিস্ট সম্প্রদায়ের মাধ্যমে বিতর্কের প্রকাশ। সোফিস্ট প্রোটাগোরাস ( চৎড়ঃধমড়ৎধং -৪৯০-৪২০ ইঈ) এর মাধ্যমে বিতর্কের গোড়াপত্তন এবং মহামতি দার্শনিক সক্রেটিসের ( ৪৭০-৩৯৯) মাধ্যমে বিতর্ক জনপ্রিয়তা এবং প্রায়োগিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।

প্রাচীন বিতর্কের প্রেক্ষাপটের তুলনায় বর্তমান কালের বিতর্ক চর্চার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। প্রাচীনকালে বিতর্ক চর্চা ছিল জীবনভিত্তিক। বর্তমান বিতর্ক একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করার কারণে সমাজের প্র্যাকটিকাল জায়গুলোতে বিতর্ক করার পূর্বে ডিবেটিং ক্লাবগুলোর মাধ্যমে নিজের উপস্থাপনা ও যুক্তি প্রদানের যোগ্যতাকে শাণিত করে নেয়ার একটি সুযোগ থাকে। আধুনিক সময়ে আমরা বিতর্কের যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেখতে পাই তা মূলত ইউরোপের আঠারো শতকের নবজাগরণের সময় হয়েছিল। এ সময়ে লন্ডনে ডিবেটিং সোসাইটি গড়ে ওঠে এবং দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বাংলাদেশে বিতর্কের সূচনা খুব বেশি পুরাতন নয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আশির দশকের প্রারম্ভে বিতর্কের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে বিতর্ক একটি সংঘবদ্ধ রূপ লাভ করেছে। বাংলাদেশে বিতর্ককে জনপ্রিয় করে তুলতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন। বিভিন্ন প্রজন্মের বিতার্কিকগণ বিটিভিতে প্রদর্শিত বিতর্ক অনুষ্ঠান দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে।

বিতর্ক হচ্ছে যুক্তির খেলা। এর ফলে শিক্ষার্থীরা প্রতিপক্ষকে যুক্তি দিয়ে ঘায়েল করার কৌশল শিখে। যেকোন বিষয়ে দ্রুত যৌক্তিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়ে । মূলত বিতর্ক কোনো অনুষ্ঠান নয়, বিতর্ক হচ্ছে চর্চার বিষয়। এই চর্চার হবে প্রতিভা, মেধা- মননের যুক্তির চর্চার বিষয়। এই চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যুক্তির অনুসন্ধান, যুক্তির উপলব্ধি, পরমতসহিষ্ণুতা তথা অন্যের মতামতকে সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাঙ্খিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রস্তুত হতে হবে।

মুক্তচিন্তা, বিতর্ক ও গণতন্ত্র অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রই হচ্ছে পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল আচরণ। বিতর্ক আমাদের এ শিক্ষাই প্রদান করে। পছন্দের হোক বা না হোক প্রতিপক্ষের বক্তব্যকে একজন বিতার্কিককে মন দিয়ে শুনতে হয়। এরপর নিজের অকাট্য যুক্তি দিয়ে তিনি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে তার বক্তব্য অধিকতর যৌক্তিক, তবে তিনি বিজয়ী। অর্থ্যাৎ পেশিশক্তি নয়, যুক্তির শক্তি দিয়ে এখানে জয় পরাজয় নির্ধারিত হচ্ছে। জোরের যুক্তি নয়, যুক্তির জোর এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে। এটাই প্রকৃত গণতান্ত্রিক চেতনা। যা যৌক্তিক ও সঙ্গত, যেদিকেই বিজয়। আমরা প্রায়ই শুনি শক্তিশালী গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদের কথা। যুক্তিস্নাত সেই রাঙা প্রভাতটি বিতার্কিকরাই এনে দিতে পারেন।

বার্তাবাজার/এম আই