মাশরাফি বিন মর্তুজার পর তামিম ইকবাল। ভাবছেন, সেটা আবার কী? খুব এলোমেলো মনে হচ্ছে, তাই না? নাহ! খুব জটিল মনে হওয়ার কিছু নেই। এই দু’জনের ঘটনায় সংযোগ তো অবশ্যই আছে। ব্যাপারটা হলো- মাশরাফি এবং তামিম কেউই মুখ ফুটে বলেননি। অবসরের ঘোষণার সময় একবারের জন্যও মুখে আনেননি, “অমুকের কারণে আমি ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ালাম। কিংবা আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার পেছনে ‘অমুক’ দায়ী।”

তবে কমবেশি সবাই জানেন, বোঝেন- মাশরাফির বিন মর্তুজার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার শেষ হয়েছিল চন্ডিকা হাথুরুসিংহের অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে।

প্রথমবার বাংলাদেশের কোচ হয়ে আসার পর একটা পর্যায়ে মাশরাফির ওপর অসন্তুষ্ট হন হাথুরুসিংহে। মাশরাফিকে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের জন্য নানাভাবে তাড়া দেন তিনি। এক পর্যায়ে ত্যক্ত, বিরক্ত হয়ে মাশরাফি ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল টস করার পর ঘোষণা দিয়ে বসেন, ‘আগামী ৬ এপ্রিলের ম্যাচটিই আমার শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। এরপর আর অধিনায়কত্ব করবো না। খেলবোও না।’

ওই সময়ই ইতি ঘটে মাশরাফির টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে হিসাব করলে, ওই ঘটনার পর কেটে গেছে ৬ বছরের বেশি সময়। মাশরাফি এখনো ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট, বিশেষ করে বিপিএল খেলছেন। ভালোই খেলছেন। এখনো বোলার মাশরাফি আলোচিত, আলোড়িত। বল হাতে নিয়মিত সাফল্য পাচ্ছেন। এবারের বিপিএলেও বোলার মাশরাফি দারুণ পারফর্ম করেছেন।

কিন্তু জাতীয় দলে মাশরাফির টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের ইতি ঘটেছে অর্ধযুগ আগে। ঠিক একইভাবে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ দলের হেড কোচ হয়ে আসার পর হাথুরুসিংহের দ্বিতীয় শিকার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়ের ঘোষণা দিলেন তামিম ইকবাল।

মাশরাফির মতো তামিমও বিদায়ের দিনে বলেননি যে, আমি কোচ হাথুরুর কারণেই জাতীয় দল থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিচ্ছি। তবে বিদায়ের ক্ষণে তার কান্না, শরীরী অভিব্যক্তি আর কথা-বার্তায় পরিষ্কার বোঝা গেছে, রাজ্যের অভিমান, এক বুক কষ্ট, বুক ভরা দুঃখ নিয়েই অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন এবং সে কষ্টটা কোচ হাথুরুরই দেওয়া।

এরই মধ্যে চাউর হয়েছে, এবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের আগে তামিম নিজেকে শতভাগ ফিট মনে না করেও প্রথম ম্যাচ খেলার ঘোষণা দেন। আর তা মোটেও ভালোভাবে নেননি হাথুরু। তিনি ভাবেন, আমি হেড কোচ। আমার মতামত না নিয়ে তামিম নিজেকে শতভাগ ফিট না ভেবেও প্রথম ম্যাচ খেলার কথা বলে কী করে?

এই ক্ষোভ থেকেই বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কাছে ফোন করে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন টাইগার কোচ এবং অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কোচের এমন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনও।

দেশের ক্রিকেটের দুই প্রধান অভিভাবক তার ওপর অসন্তুষ্ট এবং সে অসন্তুষ্টির কথা পত্রিকার পাতায়ও চলে এসেছে। এটা তামিমকে খুব দুঃখ দিয়ে থাকবে। তিনি ধরেই নিয়েছেন, বিসিবি প্রধান আর হেড কোচ- দুজনই আমার ওপর অসন্তুষ্ট। আমার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পথে এটা এক বড় বাধা। এই বাধার প্রাচীর টপকে আমার টিকে থাকা সঠিক হবে না। এমন ভেবেই হয়তো ওয়ানডের সঙ্গে টেস্ট থেকেও সরে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করেছেন তামিম।

তার শতভাগ ফিট না হয়েও খেলার ইচ্ছে প্রকাশ, ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচ খেলে ব্যর্থ হওয়া এবং দলের হেরে যাওয়া- সব কিছুই তামিমের বিপক্ষে গেছে। তাই তামিম ধরে নেন, এখন আমার দলে থাকতে হলে বিসিবি সভাপতি আর হেড কোচের গলগ্রহ হয়েই থাকতে হবে। তারচেয়ে সরে দাঁড়ানোই উত্তম। তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সব ফরম্যাট থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেন তিনি।

অনেকেরই মতো, তামিমের প্রথম ম্যাচ খেলা নিয়ে হাথুরুসিংহে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কাছে ফোন করে রাজ্যের ক্ষোভ প্রকাশ না করলে হয়তো পরিস্থিতি এমনটা হতো না। বিসিবি প্রধান নিজেও যদি মিডিয়ায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করতেন, তাহলে তামিম হয়তো এত বড় সিদ্ধান্ত নিতেন না।

তাই বলাই যায়, তামিমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের অবসরের ঘোষণাই এসেছে পাপনের কাছে হাথুরুর ফোনের পরপরই। প্রশিক্ষক হিসেবে তামিমের শতভাগ ফিট না হয়েও খেলার ইচ্ছেটা সমর্থন করেননি হাথুরু। পেশাগত দিক থেকে সেটা দোষের নয়। ঠিকই আছে। কোচ হিসেবে তিনি আনফিট তামিমকে খেলা থেকে বিরত রাখতেই পারেন।

কিন্তু বিসিবি সভাপতির কাছে ফোন করে নানারকম নেতিবাচক কথা-বার্তা বলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেয়ে টিম মিটিংয়ে তামিমকে সোজা বলে দিতে পারতেন, ‘নাহ! পুরোপুরি ফিট না হয়ে তুমি খেলতে পারবে না।’ তখন পরিস্থিতি এমন নাও হতে পারতো।

কাজেই হাথুরুর ওই ফোনেই যে তামিমের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি ঘটলো, তা কী আর ভেঙে বলার অপেক্ষা রাখে?

বার্তাবাজার/এম আই