যুব মহিলা লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেত্রী কারাবন্দী শামীমা নুর পাপিয়াকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগার থেকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে।

গতকাল সোমবার (৩ জুলাই) বিকেল ৫টায় তাকে বিশেষ নিরাপত্তায় গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে কুমিল্লা কারাগারে পাঠানো হয় বলে নিশ্চিত করেছেন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) ওবায়দুর রহমান।
তিনি জানান, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কারণে কারাগার অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এ কারাগারে বন্দী শামীমা নুর পাপিয়াকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে।

জানা যায়, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে বন্দী থাকার সময় পাপিয়া ও তার অপর সহযোগীর বিরুদ্ধে কারাগারের হাজতি ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী রুনা লায়লাকে নির্যাতন এবং তার কাছে থাকা টাকা-পয়সা লুট করার অভিযোগ উঠে।

নির্যাতনের শিকার রুনা লায়লা গাজীপুরের কাপাসিয়া থানার কড়িহাতা গ্রামের আব্দুল হাইয়ের মেয়ে এবং মৃত একেএম মাহমুদুল হকের স্ত্রী। তিনি গত ১৬ জুন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলেন এবং গত ২৭ জুন জামিনে মুক্তি পেয়ে বর্তমানে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

রুনা লায়লার ভাই আব্দুল করিম এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কাছে গত ২৫ জুন লিখিত অভিযোগ করলে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
আব্দুল করিম জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগে বলেন, গত ২২ জুন সকাল ১০টায় কাশিমপুর কারাগারে বন্দী আমার বোনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমার বোনের নাম-ঠিকানা নেওয়ার ৩ ঘণ্টা পর সাক্ষাতের টিকিট কাউন্টার থেকে আমাকে জানানো হয় ‘ডিও নাই’, দেখা করা যাবে না। তারপরও আমি সেখানে অপেক্ষা করতে থাকি। পরে জামিনে বের হয়ে আসা অন্য হাজতিদের কাছে আমার বোন সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা আমাকে জানায়, আমার বোন রুনা লায়লাকে পিটিয়ে মারাত্মক আহত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। তখন আমি উদ্বিগ্ন হয়ে ফিরে যাই এবং পরের দিন আবার কারাগারে আমার বোনের সঙ্গে দেখা করতে যাই। পরে জানতে পারি, আমার বোনের কাছে ৭ হাজার ৪০০ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। সেই টাকা কেড়ে নেওয়ার জন্য কারাগারে দায়িত্বে থাকা মেট্রন হাবিলদার ফাতেমা বেগম, নাসিমা আক্তার, হাজতি ও কয়েদিসহ যুব মহিলা লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেত্রী কারাবন্দী শামীমা নুর পাপিয়া, সোনালি, আনন্দিকা, অবন্তিকা ও নাজমা আমার বোনকে সিসি ক্যামেরা নেই এমন স্থানে নিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। একপর্যায়ে আমার বোন রক্তবমি করে এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান ফেরার পর আবারও তাকে পেটানো হয়।

আব্দুল করিম আরও অভিযোগ করেন, ২৩ জুন আমার বোনের সঙ্গে দেখা করার জন্য ফের কারাগারের সাক্ষাৎ কাউন্টারে টিকিট কাটতে গেলে টিকেটম্যান আমাকে কাশিমপুর কারাগারের অভিযোগ কেন্দ্রের ইনচার্জ আলেয়ার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমরা আলেয়ার কাছে গেলে তিনি আমাদের বসিয়ে রেখে ডেপুটি জেলার জান্নাতুল তায়েবাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। জান্নাতুল তায়েবার কাছে আমার বোনকে মারধর করে আহত করার কথা জানালে তিনি বলেন, আপনার বোনের কিছু হয়নি। আমার বোনের সঙ্গে দেখা করার কথা বললে জান্নাতুল তায়েবা বলেন, দেখা করা যাবে না। তখন জান্নাতুল তায়েবার সঙ্গে আমাদের কথা কাটাকাটি হয়। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই জান্নাতুল তায়েবা আমার বোনের সঙ্গে আমাদের দেখা করতে দেননি।
পরে ডেপুটি জেলার জান্নাতুল তায়েবা আমার বোনের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিতে চান। ওই দিন দুপুর ২টায় একটি মোবাইল ফোনে অপরিচিত মহিলার কণ্ঠে আমার বোন বলে পরিচয় দিয়ে কথা বলান। কিন্তু ওই মহিলা আমার বোন রুনা লায়লা ছিল না। রুনা সাজিয়ে অন্য মেয়েকে দিয়ে কথা বলানো হয়। ডেপুটি জেলার জান্নাতুল তায়েবা অন্য একজন মহিলাকে আমার বোন সাজিয়ে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। উক্ত বিষয়টি ওই কারা কর্তৃপক্ষকে অবগত করার পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, নথি চুরির একটি মামলায় শিক্ষানবিশ আইনজীবী রুনা লায়লাকে ১৬ জুন কাশিমপুর মহিলা কারাগারে আনা হয়। কারাগারের সাধারণ ওয়ার্ডে নেওয়ার পর রুনার দেহ তল্লাশি করে কর্তব্যরত মেট্রন তার কাছে ৭ হাজার ৪০০ টাকা পান।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রুনা লায়লা বলেন, আমার কাছে ৭ হাজার ৪০০ টাকা ছিল। সেই টাকা কেড়ে নেওয়ার জন্য কারাগারের হাজতি যুব মহিলা লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নুর পাপিয়াসহ তার সহযোগীরা সিসি ক্যামেরা নেই এমন স্থানে নিয়ে যায়। টাকা চাইলে দিতে অস্বীকার করলে তারা জোর করে সেই টাকা নিয়ে যায়। পরে পাপিয়া ও তার সহযোগীরা শিকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে অমানবিকভাবে আমাকে মারধর করে। আমাকে না মারার জন্য পাপিয়ার হাত-পায়ে ধরেছি। কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। আরও বেশি করে আমারে মেরেছে।

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম বলেন, তার (রুনা লায়লা) শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা চলছে।

কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, বন্দী এক হাজতিকে নির্যাতনের ঘটনায় তিনজনকে শোকজ করা হয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ঘটনাটি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শোকজ করা তিনজন হলেন- ওই কারাগারের জেলার ফারহানা আক্তার, ডেপুটি জেলার জান্নাতুল তায়েবা ও মেট্রন হাবিলদার ফাতেমা।
তিনি আরও বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন জমা হলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া কারাগারের ভেতরে এমন ঘটনা যাতে আর না হয়, সে বিষয়েও খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।