ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় মধুমতি নদী তীরবর্তী মানুষ ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত পার করছেন। চোখের পলকেই নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে মাথাগোঁজার একমাত্র ঠিকানা। কেউ কেউ বাপ-দাদার ভিটে সরিয়ে অন্য জায়গা চলে যাচ্ছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, মধুমতি নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আলফাডাঙ্গা উপজেলার পাঁচুড়িয়া ও উত্তর চরনারানদিয়া গ্রামে মধুমতি নদী তীরবর্তী প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক দিনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এক থেকে দুই কিলোমিটার জায়গা। এতে কমপক্ষে ২০-২৫টির বেশি ঘর অন্য জায়গা সরিয়ে নিতে হয়েছে। অনেকে খোলা জায়গায় বসবাস করছে। অনেকে আবার শেষ সম্বল ঘরবাড়ি, গাছপালা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কেউ কেউ বাড়ির চাল খুলে অন্য জায়গায় রাখলেও খাম ও বেড়া লাগিয়ে রাখছে, যদি থামে নদীর ভাঙন। এদিকে ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে কমপক্ষে ৩০০ পরিবার। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে পাঁচুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাঁশতলা বাজার, পাকা সড়ক, দুইটি মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ ও কবরস্থানসহ শত শত বিঘা আবাদি জমি, গাছ-পালাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

এদিকে ভাঙন ঠেকাতে বিভিন্ন পয়েন্টে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলানোর কাজ করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে সেগুলো প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

নদী তীরের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব রাহেলা বেগম বলেন, ‘সংসারের এটা-সেটা কাজ করে গভীর রাতে বিছানায় যাই। ক্লান্ত শরীরে দ্রুত ঘুম আসে। হঠাৎ নদী ভাঙনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। আতঙ্কিত হয়ে পড়ি এই বুঝি ঘরবাড়ি ভেসে যায়! পরে এই চিন্তায় রাতে আর ঘুম হয় না।’

উত্তর চরনারানদিয়া গ্রামের মো. মজিবুর মোল্যার বসতভিটা নদীতে আগেই বিলীন হয়ে গেছে। নিজের সহায়-সম্পত্তি বলতে কিছুই আর নেই। বর্তমান তিনি তার নব্বই বছর বয়সী বৃদ্ধা মাকে নিয়ে নদী তীরে অন্যের জমিতে একটি ছাপড়া ঘরে থাকেন। এখন সেই ছাপড়া ঘরও নদীতে বিলীন হওয়ার উপক্রম। এরপর কোথায় হবে একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই। সেই চিন্তার ছাপ মুজিবুর মোল্যার।

নদী তীরের আরেক বাসিন্দা রেখা বেগম। স্বামী মারা গেছে ২৩ বছর আগে। স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ সম্বল বলতে বাড়ির এই ভিটাটুকুই আছে। কিন্তু যেকোন মুহুর্তে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে মাথাগোঁজার শেষ আশ্রয়স্থল। কান্নাজড়িত কন্ঠে রেখা বেগম বার্তা বাজার’কে বলেন, ‘সারা রাত ঘুম ধরে না, সব সময় ভয়ে আতঙ্কে থাকি এই বুঝি বাড়ি ভাইঙা পড়ে নদীতে। এবার বুঝি আর বসতভিটায় থাকা হবে না। কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিব, দিশে খুঁজে পাচ্ছি না।’

ভাঙন আতঙ্কে অন্যত্র ভিটে সরিয়ে নিয়েছে নজির মোল্যা। তিনি জানান, ‘শুনেছি এই জায়গা স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে। কিন্তু আমাদের আর সেই সুখ কপালে নেই। তার আগেই বাপ-দাদার ভিটা নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।’

চরনারানদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. ইয়াছিন মোল্যা জানান, ‘ভাঙন ঠেকাতে পাউবো জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৬ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে আলফাডাঙ্গা উপজেলার মধুমতির অব্যাহত নদীভাঙন রোধে গৃহীত একটি প্রকল্পে স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে আলফাডাঙ্গা উপজেলার পাঁচুড়িয়া ইউনিয়নের তিনটি পয়েন্টে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে।

জানতে চাইলে ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সন্তোষ কর্মকার বার্তা বাজার’কে বলেন, ‘ভাঙন এলাকায় বরাদ্দ অনুযায়ী আপদকালীন জিওব্যাগ ফেলানো হচ্ছে। আগামী অক্টোবর মাস থেকে ভাঙন এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে বলে জানান তিনি।

বার্তা বাজার/জে আই