কথা ছিলো রাতে নানির সঙ্গে একসাথে ভাত খাবে। তবে বাড়ি ফিরলেন ঠিকই তবে লাশ হয়ে। দুপুরে মুরগীর মাংস, শাক, ডাল ও দুধ দিয়ে ভাত খাইয়েছিলেন নানি মমতা বেগম। রাতে একসঙ্গে ভাত খাবেন বলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল আমার ভাই। আমরা জানতাম, ভাই আমার মোটরসাইকেল চালাতে গেছে। সেই যে খেয়ে গেলো, এরপর আর আমার ভাই ফিরে আসেনি। আমাকে নানী বলে ডাকেনি। মৃত্যুর তিনদিন পরেও নাতিকে হারিয়ে এভাবেই আহাজারি করছেন শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে পদ্মা নদীতে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো কিশোর মোক্তারের নানী বৃৃদ্ধা মমতা বেগম।

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) সকালে উপজেলার সখিপুর থানার উত্তর তারবুনিয়া ইউনিয়নের মোল্লা কান্দি গ্রামে মোক্তারের নানা বাড়ি গিয়ে এমন দৃশ্যই দেখা যায়।

নিহত মোক্তার হোসেন গাজী (১৬) মোল্লা কান্দি গ্রামের বাচ্চু গাজীর ছেলে। (গত ৯ মার্চ) শনিবার রাতে পদ্মা নদীর এই স্পিডবোট দুর্ঘটনায় শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনের ৩ ম্যাজিস্ট্রেটসহ ৯ হন আহত হয়েছে। এর মধ্যে বাসিত-সাত্তারের অবস্থা অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

নিহত মোক্তার গাজীর পারিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মোক্তারের জন্মের ৩ বছর পর পারিবারিক কলহে তার মা বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর দুঃখ-কষ্টকে সঙ্গী করে বৃদ্ধ নানা-নানী কাছে থেকে বড় হয়। ছোটবেলা থেকেই একটি চায়ের দোকানে শ্রমিকের কাজ করত মোক্তার। কিছুদিন আগে তার কিছু টাকা জমিয়ে মামার সহযোগিতায় একটি মোটরসাইকেল ক্রয় করে । এরপর চায়ের দোকান ছেড়ে ওই মোটরসাইকেল যোগে ভাড়ায় যাত্রী সেবা দিয়ে সে উপার্জন করত। একটু সুখের আশায় ছোট বেলা থেকে বাবা-মায়ের আদর সেহ্ন বঞ্চিত মোক্তারকে বিদেশে পাঠানোর চিন্তা করেছিল তার স্বজনরা। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন স্পিডবোট দুর্ঘটনায় শেষ হয়ে গেছে।

গত শনিবার (৯ মার্চ) ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাঁচিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইউনিয়নটির একাংশ পদ্মা নদীর ওপারে হওয়ায় ভেদরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন ম্যাজিস্ট্রেট, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নদীর ওপারে আনা-নেওয়ার জন্য বারেক প্রধানিয়া নামের এক স্পিডবোট চালকের সঙ্গে চুক্তি করে। নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে কাঁচিকাটা প্রান্ত থেকে ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা বারেক প্রধানিয়ার স্পিডবোটে পদ্মা পাড়ি দেন। অন্যদিকে কাঁচিকাটা থেকে নির্বাচিত কাজে নিয়োজিত আরও যাত্রী আনার জন্য বারেক প্রধানিয়ার ছেলে সাইফুল প্রধানিয়া আরেকটি স্পিডবোটযোগে মোক্তার গাজীকে সঙ্গে নিয়ে চেয়ারম্যান বাজার স্টেশন থেকে কাঁচিকাটা রওনা করেন। এরপর স্পিডবোট দুইটি দুলারচর এলাকার মনাই হাওলাদারকান্দি ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছালে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে গুরুতর আহত ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের স্থানীয়রা শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। অন্যদিকে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় মোক্তার গাজীকে নিকটস্থ চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মোক্তার গাজীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছেন তার নানী মমতা বেগম।

প্রতিবেশী মিলন গাজী বলেন, খুব ভালো ছেলে ছিল মোক্তার। নানী বাড়ি থেকেই সে বড় হয়েছে। নানীই তাকে লালন পালন করেছে। নাতির মৃত্যুতে বৃদ্ধ নানী কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে ফেলেছেন। আমাদের সাথে খুব ভালো আচরণ করতো।

মোক্তারের মামি নূর জাহান বলেন, ছেলের মতোই বড় করেছি আমরা মোক্তারকে। সকালে আমার ছেলেকে নিয়ে মোটরসাইকেলে পুরো চর ঘুরে এসেছে। মামা তোকে খুঁজবে এই কথা বলার পরেও সে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছিল। এরপর আমরা ফেসবুকে খবর পেয়েছি মোক্তার মারা গেছে। মোক্তারের মৃত্যুতে আমি আমার একটি সন্তান হারালাম।

মামা বাদল মোল্লা বলেন, কিশোর বয়স এখনও পেরোয়নি আমার ভাগিনার। এই বয়সে মোক্তারকে আমাদের হারাতে হয়েছে। এই কষ্ট কেমনে মেনে নেব।

নাতি হারিয়ে শোকে কাতর নানী মমতা বেগম । তিনি বলেন, আমার ভাইকে আমি কত আদর করতাম। আমি ভাইকে মুরগীর মাংস, দুধ দিয়ে ভাত খাওয়াইলাম। খেয়ে বাড়ি থেকে গেল, আর ফিরে আসল না আমার ভাই। বললো রাতে একসঙ্গে ভাত খাবে কিন্তু আর আইলো না। আমার ভাইকে আইনা দেন।

ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিবুল ইসলাম বলেন, অভাবের কারণে শিশু বয়সেই মোক্তারকে স্থানীয় একটি চায়ের দোকানে শ্রমিকের কাজ করতে হয়েছে। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে ভাড়ায় মোটরসাইকেল যোগে যাত্রী আনা নেওয়া করত। তার মৃত্যুতে উপজেলা প্রশাসন ও এলাকাবাসী শোকাহত।

এবিষয়ে সখিপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান বলেন, পদ্মা নদীতে স্পিডবোট দুর্ঘটনার বিষয়ে এখনো কোনো মামলা হয়নি। নিহত মোক্তার গাজীর পরিবার মামলা করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।