শরীয়তপুরে বাপ-দাদার জন্ম ভিটা দেখতে এসে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কথা ও সুরে ‘বেলা বয়ে যায়, ছোট্ট মোদের পানসী তরী, সঙ্গে কে কে যাবি আয়’ গানটি গেয়েছেন ভারতের বিখ্যাত সংগীত শিল্পী পঞ্চকবিকন্যা খ্যাত ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায়। শিল্পীর কণ্ঠে গান শুনে জেলা প্রশাসকসহ শরীয়তপুরের কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ও গণীজনরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বেলা সাড়ে ১১ টায় শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন ও পালংয়ের নাগরিক সমাজ ভারতের জাতীয় অনন্যা হিসেবে পরিচিত ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা দিয়েছেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে তিনি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কথা ও সুরে সবাইকে গান শুনিয়েছেন।

শরীয়তপুরের পালংয়ে জন্ম নেওয়া সত্যপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে পঞ্চকবিকন্যা খ্যাত ঋদ্ধি তার স্বামী ড. দেবজিৎ বন্ধ্যোপাধ্যায়ের পদবীর সঙ্গে মিল রেখে ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায় নামেই বর্তমানে পরিচিত।

জেলা প্রশাসন ও ভারতের ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায় মিউজিক একাডেমির শিল্পীদের সূত্রে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন ও অতুল প্রসাদ সেন তথা পাঁচ কবির লেখা প্রায় পাঁচ শতাধিক গান ও কবিতায় কন্ঠ দিয়ে ভারত, বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের বাংলা ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীর কাছে তারকা খ্যাতি পেয়েছেন ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে এক নামে সবাই চিনলেও অতুল প্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্ত সেনকে মানুষ কম চিনেন। এই পাঁচ কবির গান নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন করে পৌঁছে দিতে কাজ করছেন ঋদ্ধি বন্ধোপাধ্যায়। তারকা খ্যাতি পাওয়া এই শিল্পীর জন্ম ভারতে হলেও তার দাদা ক্ষিরোদবন্ধু চট্টোপাধ্যায়, বাবা সত্যপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের আধি নিবাস শরীয়তপুরের পালং থানা এলাকায়। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় তারা কলকাতায় চলে যান ঋদ্ধির বাবা ও দাদা। চট্টোপাধ্যায়দের ছেড়ে যাওয়া ওই বাড়ির ওপর রয়েছে শরীয়তপুরের বর্তমান সদর হাসপাতাল। ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায় সংগীতের টানে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও এসেছেন কয়েকবার। তবে বাপ-দাদার জন্ম ভিটার সঠিক স্থান খুঁজে না পাওয়ায় এর আগে কখনো তিনি পালংয়ে আসেননি। ঋদ্ধি বন্ধোপাধ্যায়ের বাবা সত্যপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বর্তমানে বার্ধক্য জনিত বিভিন্ন রোগে কলকাতার বাড়িতে অবস্থান করে জন্ম ভিটের স্মৃতিচারণ করে সময় পার করছেন। জন্ম ভিটের মাটির গন্ধ নিতে চান বাবা, কিন্তু অসুস্থ্যতার কারণে আসতে না পারায় ঋদ্ধি বাপ-দাদার জন্ম ভিটের এক চিলতে মাটি নিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. গোলাম মোস্তফার সহযোগিতা কামনা করলে তিনি তার বাপ-দাদার স্মৃতি জড়িত ভিটে মাটির সন্ধান করে দেন। পরে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত গুণী এই সংগীত শিল্পী শরীয়তপুরের পালংয়ে আসতে চান মর্মে জেলা প্রসাশনকে জানানো হলে প্রসাশন ও পালংয়ের নাগরিক সমাজ তাকে স্বাগত জানিয়ে সংবর্ধনার আয়োজন করে। জন্ম ভিটের এক চিলতে মাটি নিতে এসে প্রশাসন ও জেলার কবি, সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের গুণীজনদের থেকে সংবর্ধনা পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন এই শিল্পী। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে ঋদ্ধি বন্ধোপাধ্যায় সকলের অনুরোধে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কথা ও সুরে ‘বেলা বয়ে যায়, ছোট্ট মোদের পানসী তরী, সঙ্গে কে কে যাবি আয়’ গানটি শুনিয়ে সবাইকে উচ্ছ্বসিত করেছেন।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রথীন্দ্র সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ও লোকজ গবেষক শ্যামসুন্দর দেবনাথ বলেন, ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায় শরীয়তপুরের মেয়ে। কাঁটাতার আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। কেননা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি একই। ঋদ্ধি বন্ধোপাধ্যায়, নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া গীতা দত্ত, পালা সম্রাট ব্রজেন্দ্রনাথ সহ উপমহাদেশে বিখ্যাত অনেক গুণীজনের স্মৃতি ধন্য এই পালং। তাদের সকলের স্মৃতি রক্ষার্থে জেলা প্রশাসককে উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব করছি। ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায়কে শরীয়তপুরের কবি ও সাহিত্যিকদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাই।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দে বলেন, ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক কয়েক হাজার বছরের। ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায়ের মতো গুণী শিল্পী পালংয়ের মেয়ে, এটা পালং বাসীর জন্য গর্বের, আনন্দের। জেলা প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ তাকে সংবর্ধিত করে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক আরও মজবুত করেছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী। আমি ঋদ্ধি বন্ধোপাধ্যায়কে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাই।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায় বলেন, আমি বাপ-দাদার স্মৃতি ধন্য পালংয়ের এক চিলতে মাটি নিতে চেয়েছিলাম। সেই মাটি নিতে আসা উপলক্ষ্যে জেলা প্রশাসন, কবি, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিকসহ শিল্পীদের সকল অঙ্গনের মানুষ আমাকে সংবর্ধিত করেছে। এই পালং আমার বাপ-দাদার ভিটে বাড়ি। বাপ-দাদার স্মৃতিধন্য এই মাটিতে আমি এখন থেকে বারবার আসব। ইতিহাস থেকে শুনেছি আমার বাপ-দাদার বাড়িতে শরীয়তপুরের বর্তমান সদর হাসপাতালটি রয়েছে। জনকল্যাণকর এই হাসপাতালের একটি স্থাপনার নামকরণ আমার দাদা বা বাবার নামে করার দাবি জানিয়েছেন আমার ৯১ বছর বয়সী বাবা সত্যপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। এই আবেদন আমি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারের কাছে রাখছি। পালংয়ে এসে আমি পূর্ব পুরুষের ভিটে মাটির গন্ধ নিয়েছি।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায় শরীয়তপুরের কন্যা, উনি আমাদেরই একজন। কাঁটাতারের বেড়া থাকে মাটিতে, আর হৃদয়ের কোনো কাঁটাতার নেই। ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায় আমাদের হৃদয়ের মানুষ, সংস্কৃতির মানুষ, আমাদেরই কন্যা। ঋদ্ধি বন্ধোপাধ্যায় শরীয়তপুরে এসে আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি ঋদ্ধি বন্ধোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের সেতুবন্ধন। শিগগিরই শিল্পকলার উদ্যোগে আয়োজন করে ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায়কে শরীয়তপুরের সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করব। সেই আয়োজনে ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায় তার বাপ-দাদার স্মৃতি ধন্য পালং বাসীকে গান শোনাবেন।

পালংয়ের এক চিলতে মাটি নিতে এসে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ঋদ্ধি বন্ধ্যোপাধ্যায়ের সফর সঙ্গী হয়েছেন ভারতের সংগীত শিল্পী ইন্দ্রানী বসু, সুর্মিলা গুহ, উর্মি দেবনাথ, সুতপা দত্ত, রত্না সরকার, সোনালি বসু ভট্টাচার্য ও বাসুরী রায়। তারা সবাই বিভিন্ন ভাবে পালংবাসীর আত্মীয় স্বজন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, পুলিশ সুপার মাহবুবুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. গোলাম মোস্তফা, সহযোগী অধ্যাপক হোসনে আরা বেবি, ভাষা সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল আহমেদ, শরীয়তপুর পৌরসভার মেয়র পারভেজ রহমান জন, কবি রথীন্দ্র ঘটক চৌধুরীর ছেলে অমিত ঘটক চৌধুরী, শিল্পকলা একাডেমির নির্বাহী সদস্য আব্দুর রব কোতোয়ালসহ অন্যান্যরা।