ডাকাতির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধে গুলিতে পঙ্গু হতে হয়েছে আরো পনেরো বছর আগেই। তাতেও খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, জমি দখল ছাড়তে পারেননি কুতুবপুরের বহুল আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী, ৪টি হত্যাসহ ১৯টি মামলার আসামি মীর হোসেন মীরু৷ শতাধিক দুর্ধর্ষ ক্যাডার নিয়ে পুরো কুতুবপুর ইউনিয়নকেই অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছেন কুতুবপুরের আতঙ্ক মীরু।

স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, ফরিদপুর থেকে আশির দশকের কুতুবপুরে আসেন মীরুর বাবা দিনমজুর নুরু মিয়া৷ হতদরিদ্র নুরু মিয়া বসবাস করতেন কুতুবপুরের বৌবাজারে বেড়ায় ঘেরা এক ছাপড়া ঘরে৷ সেখানেই শৈশব-কৈশোর কেটেছে একসময়ের ছিঁচকে সন্ত্রাসী মীরুর৷ ২০০৯ সাল পর্যন্ত ভাড়ায় ডাকাতি ও ছিনতাইকারী দলের সদস্য হিসেবে কাজ করে আসা মীরুকে ডাকাতির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে গুলিতে পঙ্গু হয়ে যায় মীরু৷ এরপর সন্ত্রাসের অন্ধকার ও কলঙ্কিত জগতের অধিপতি হয়ে যান মীরু৷ অস্ত্রধারী শতাধিক সন্ত্রাসী নিয়ে কুতুবপুরবাসীকে জিম্মি করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জনসাধারণ জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসী মীরু যে কতোটা দুর্ধর্ষ তা এলাকার প্রত্যেক এলাকার মানুষ জানে৷ খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, জমি দখলে কেউ বাধা দিলে বা প্রতিবাদ করলেই তার উপর নেমে আসে অত্যাচারের খড়গ৷ খুন, সন্ত্রাস, জমি দখলের অবৈধ টাকায় লেবার নুরু মিয়ার সন্তান মীরু ইতোমধ্যে বৌবাজারে গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি৷ সেই বাড়িতে আদালত স্টাইলে বিচারের নামে টর্চার সেল পরিচালনা করে মীরু৷ তার কথার অবাধ্য হলেই যেকাউকে ধরে নিয়ে এসে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়৷

মীরুকে তাই স্থানীয় জনসাধারণ কুতুবপুরের ভাইরাস নামেও আখ্যা দেন৷ এসপি হারুনের সময়কালে শীর্ষ সন্ত্রাসী মীরুকে গ্রেফতার করা হয়৷ পুলিশের হেফাজতে একদিন থাকার পরে পরের দিন পুরো মুখ রুমালে ঢেকে আদালতে আসে মীরু৷ তখন আদালতপাড়া গুঞ্জন ওঠে, জিজ্ঞাসাবাদে এসপি হারুনের জামাই আদরে মীরুর চোখ-মুখ ফুলে যাওয়াতেই লজ্জায় রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকেছিলেন মীরু৷ মীরুর শেল্টারেই কুতুবপুরজুড়ে চলছে অবাধে মাদক, সন্ত্রাস, জুয়ার মহামারি চলছে৷

মীরু বাহিনীর সন্ত্রাসীদের মধ্যে তার ভাগিনা ও বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড শাকিল ওরফে কিলার শাকিল, কিলার আকতার, মীরুর ভাতিজা রিয়াজ, কালা জাহাঙ্গীর, রসুলপুরের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রবিন, চিতাশালের নাডা খোকন ওরফে পাইক্কা খোকন, বটতলার নাবিল, রসুলপুর মুরগীর ফার্মের আবির, চিতাশালের রিকশাচোর মালেক, বৌবাজার বটতলার হাসান, নয়ন, চয়ন, সোহাগ, সিয়াম, হাসান-২, রেললাইনের জনি, চিতাশাল মুসলিমপাড়ার খবির ওরফে লেবার খবির, মোহন ওরফে জুয়াড়ি গাঞ্জুটি মোহন, বটতলার মেম্বার লিটন, বৌবাজারের দিপু, রসুলপুরের পায়েল।

 

২০২০ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগে মীর হোসেন মীরুকে ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর গ্রেফতার করেছিলো ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ। ঐ বছর ৭ অক্টোবর রাতে পাগলা রেলস্টেশন এলাকায় ৪ যুবককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত ও গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করার ঘটনায় দায়ের করা মামলা তাকে গ্রেফতার করা হয়।
একই বছরের ৩ মার্চে মীরু বাহিনীর এক সদস্য হত্যা মামলার আসামীকে গ্রেফতার করে বিপাকে পড়েছিলো ফতুল্লা থানা পুলিশ। এদিন মীরু বাহিনীর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পুলিশের উপর হামলা চালিয়ে সেই সন্ত্রাসীকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।

একই বছর ১০ ফেব্রুয়ারি শাহী বাজার এলাকায় ডিস ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষ হলে ডিস ক্যাবল কর্মচারী শাজাহান নামে একজনকে প্রকাশ্যেই কুপিয়ে হত্যা করে মীরু বাহিনী। এ সংঘর্ষে আরও ৬ জনকে কুপিয়ে ও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহতও করে তারা। মীরুকে প্রধান আসামী করে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা হয়।

একই বছর ৫ জানুয়ারি মীরু বাহিনীর ৩ সন্ত্রাসীকে অস্ত্র, গুলি ও এক হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনা পুলিশ বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানা অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি এবং সালাউদ্দিন হাওলাদার নামে এক ব্যবসায়ী চাঁদাবাজির অভিযোগে দ্রুত বিচার আইনে আরও একটি মামলা করে।

২০১২ সালের ৩ নভেম্বর রাতে নিজ বাসা থেকে মীরু এবং তার সহযোগী ইকবালকে ৫ রাউন্ড গুলিভর্তি একটি পিস্তল ও ১৩ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব-১০। এঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় মীরুর বিরুদ্ধে দুইটি মামলা হয়।

২০১৩ সালের ১৪ অক্টোবর এলাকায় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে মীরু ও তার ক্যাডাররা ভাঙ্গাপুল এলাকায় গিয়ে জাকের পার্টি নেতা হোসেনের বাড়ির সামনে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় গুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

২০১৪ সালে মীরুর বিরুদ্ধে মিছিলে অংশ নেয়ার অপরাধে এই বছরের ২৮ এপ্রিল রাতে স্থানীয় দুই সহোদর আব্দুর রহমান ও সজলকে শাহী বাজার এলাকার একটি দোকান থেকে তুলে নিয়ে যায় মীরু বাহিনী। পরে তাদের এলোপাথাড়ি কুপিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সড়কের পাশে ফেলে রেখে যায়। এঘটনায় মামলা হলে মামলাটি তুলে নিতে মীরু তার শ্যালক আরিফ, শরিফ ও রিয়াজ, রাজিবসহ ১৫-২০ জনের একটি দল ওই বছরের ১২ মে রাত ১২টায় আব্দুর রহমান ও সজলদের বাড়িতে বোমা হামলা চালায় এ ঘটনায় ফতুল্লা থানায় আরও একটি মামলা দায়ের হয় মীরু ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে।

২০১৫ সালের ১০ জুন নূরুল হককে নামে এক ব্যবসায়ীকে তার মায়ের সামনেই পিটিয়ে হত্যা করে এই সন্ত্রাসী বাহিনী। ফতুল্লা মডেল থানায় মীরুর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়। একই বছরের ১৯ মার্চ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানোর অভিযোগে এক ব্যবসায়ী সন্ত্রাসী মীরুসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর দু’দিন আগে এক এএসসি পরীক্ষার্থীকে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় এলাকাবাসীর উপর হামলা চালায় মীরু বাহিনী। এ হামলায় ২০ জন নিরীহ এলাকাবাসী আহত হয়।