জলে জন্ম, জলে মৃত্যু এবং জলের সাথেই জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটানো এক সম্প্রদায়ের নাম ছিল মান্তা। জলের মানুষ হবার কারণে স্থলভাগের সাথে ছিল অনেক পার্থক্য। দেয়া হতো না যথাযথ সম্মান। লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত ছিল ছেলেমেয়েরা। এমন সম্প্রদায়ের বসবাস পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের স্লুইস খালে। চার বছর আগে ওই ইউনিয়নের জলেভাসা মান্তা সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য প্রথমবারের মত চালু হয়েছিল প্রাক – প্রাথমিক ভাসমান বোট স্কুল ‘ শিশু বাগান’।

শিক্ষকদের পরম মমতায় এই স্কুল যেন ছিল শিশুদের বেড়ে উঠার ঠিকানা। হাসি আনন্দ এবং খেলার ছলে শেখানো হতো শিক্ষার্থীদের। বইয়ের পাশাপাশি শেখানো হতো ডিজিটাল মাধ্যমেও। এই স্কুল ছিল মান্তা সম্প্রদায়ের শিশুদের শিক্ষা অর্জনের একমাত্র ভরসা। দিনের বেলায় বাবা মায়েরা যখন মাছ শিকারে নদীতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তখন ছেলেমেয়েরা শিখছে শিশু বাগানে। দেয়া হতো দুপুরের খাবার। তবে সেই ভাসমান স্কুল ভেসে ভেসেই চলে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের ছেড়ে। আর বিদায় বেলায় অঝোরে কাঁদছে শিক্ষার্থীরা। এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এলে সমবেদনা জানান অনেকেই‌। সেখানে দেখা যায় কাদাপানিতে নেমে হাত নাড়িয়ে চোখের জলে শিশুরা বিদায় দিচ্ছি হাজারো স্মৃতি বিজড়িত স্কুলকে।

বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে শুরু হওয়া প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০ টায় সংস্থার হেফাজতে বরগুনায় নিয়ে যাওয়া হয় ভাসমান স্কুলটিকে। চোখের সামনে থেকে স্কুলটি নিয়ে যাওয়ায় আবেগ ধরে রাখতে পারেনি শিশুরা। তাই স্কুলটি নিয়ে যাওয়ার সময় বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর তীরে এসে অঝোরে কাঁদছিল শিশু রাজিয়া, মিম, ছখিনা, সায়েম, শাহিদা, দ্বীন ইসলাম, রহমান, খুকুমণি, শেফালী, মর্জিনা, আমেনাসহ স্কুলটির প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী । তাদেরই কয়েকজন অশ্রুসিক্ত চোখে বলে, ‘আমরা লেখাপড়া করতে পারছি এই স্কুলের কারনে, আমাদের সেই স্কুলে আর যাইতে পারমু না।’

আর অভিভাবকরা জানান, নদী ও ডাঙায় মিলিয়ে ৩০০ শিশু রয়েছে। ভাসমান স্কুলের কারণে ধীরে ধীরে তারা স্কুলগামী হচ্ছিল। কিন্তু স্কুলটি বন্ধ হওয়ায় মান্তা শিশুদের শিক্ষা জীবন অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, যুগের পর যুগ ধরে মান্তা সম্প্রদায় ছিল শিক্ষার আলো বঞ্চিত। চরমোন্তাজ ইউনিয়নের স্লুইস গেটের খালে ১১০টি পরিবার নৌকায় করে নদ-নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছিল। যাদের কাছে শিক্ষা ছিল শুধুই মাত্র বিলাসিতা। কিন্তু তাদের শিশুদের জীবনে লাগে শিক্ষার ছোঁয়া, হৈ-হুল্লোর করে স্কুলে যাওয়ার আনন্দ। ২০১৯ সালের জুন মাসে বেসরকারি সংস্থা জাগোনারীর উদ্যোগে মুসলিম চ্যারিটির অর্থায়নে মান্তা শিশুদের জন্য চরমোন্তাজ ইউনিয়নের স্লুইস গেটের খালে ভাসমান বোট স্কুল স্থাপন করা হয়েছিল। যেখানে ছিল প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার সুযোগ। আর এই সুযোগ পেয়ে প্রাকের শিক্ষা লাভ করে অনেক শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। এরফলেই তাদের জীবনে পরিবর্তনের ছোয়া লাগতে শুরু করে। দূর হতে থাকে ডাঙার মানুষের সঙ্গে বৈষম্যও।

ভাসমান বোট স্কুলের শিক্ষক আইয়ুব খান বলেন, ‘ডাঙার মানুষের সঙ্গে আগে মান্তা সম্প্রদায়ের বৈষম্য ছিল। যার কারণে মান্তা শিশুরা ডাঙার স্কুলে পড়ালেখা করতে যেত না। কিন্তু ভাসমান স্কুল চালু হওয়ার পর ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে আধুনিকতার ছোয়া লাগে। বাবা-মা নদীতে মাছ ধরতে গেলেও বই-খাতা নিয়ে শিশুদের স্কুলে পাঠানো হতো।’ তিনি আরও বলেন, ‘নাগরিক সুবিধা বি ত এসব মানুষ পেতে শুরু করে সরকারি সুবিধাও। ৫৯ পরিবারকে দেওয়া হয় মুজিববর্ষের ঘর। ফলে ডাঙায় বসবাসের সুযোগ পান তারা। কিন্তু এখনও প্রায় অর্ধশত নৌকায়ই বাস করছে। তাদের শিশুদের জন্য ভাসমান স্কুলটি ছিল কার্যকারী। কারণ, নদীর সঙ্গেই ওদের মিতালি। কিন্তু স্কুলটি বন্ধ হওয়ায় এখন শিক্ষা জীবন থেকে অনেক শিশু ঝরে পড়তে পারে।’

কর্তৃপক্ষ জানান, মান্তা সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন ডাঙায় উঠেছে। তাদের মধ্যে আধুনিকতার ছোয়া লেগেছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে শিশুদের স্কুলগামী করার অভ্যাস করা হয়েছে। তাই প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়িয়ে মান্তা শিশুদের হাতেখড়ির সেই স্কুলটির কার্যক্রম বন্ধ করা হয়।

স্কুলটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী সংস্থা জাগোনারীর পরিচালক (যোগাযোগ) ডিউক ইবনে আমিন বলেন, ‘ভাসমান বোট স্কুল প্রকল্পের কার্যক্রম ওখানে শেষ। তবে নদী পাড়েই জাগোনারীর নির্মিত মসজিদ কাম কমিউনিটি সেন্টারের ভবনের দ্বিতীয়তলায় শিশুদের লেখাপড়ার কার্যক্রম চলবে। দুশ্চিন্তার কারণ নেই। খুব শিগগরই সেখানে আমরা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করবো।’

এ ব্যাপারে উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মো. বায়েজিদ ইসলাম বলেন, ‘মান্তা শিশুদের শিক্ষার জন্য ভাসমান স্কুলটি সহায়ক ভূমিকা পালন করছিল। ওইসব শিশুদের জন্য সরকারি স্কুল নির্মাণের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। মান্তা সম্প্রদায়কে দেওয়া মুজিববর্ষের ঘর সংলগ্ন এলাকায়ই স্কুলটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত রয়েছে।’

বার্তাবাজার/এম আই