আমাদের সমাজের নারী-পুরুষ এখনও আটকা পড়ে আছেন লিঙ্গ সমতার মাঝে। দেশ, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, বাসস্থান, এমনকি কর্মসংস্থানের উন্নয়ন হলেও, মানসিকতার উন্নয়ন যেন এখনও পিছিয়েই রয়েছে। এখনও নারীর থেকে পুরুষকেই বেশি সুযোগ দেওয়া কিংবা সাপোর্ট করাটাই বেশি চোখে পড়ে। তবে কী কখনোই এর সমাধান হবে না? কিংবা সমাধান করাই সম্ভব না?

লিঙ্গ সমতা বলতে কোনো ব্যক্তির লিঙ্গ (নাবালক ছেলে বা মেয়ে এবং সাবালক পুরুষ কিংবা নারী)। নির্বিশেষে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পদ, সুযোগ ও সুরক্ষা লাভ করা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যাপারে সমান অধিকারকে বোঝায়।

তবে তার মানে এই নয় যে, পুরুষ ও নারী হুবহু একই কাজ করার সুযোগই দিতে হবে বা সেটা সম্ভব। তবে হুবহু একই কাজ না হলেও, যেসব কাজ বা জায়গায় পুরুষের পাশাপাশি নারীও কাজ করতে পারে অন্তত সেও সকল জায়গাগুলোতে তাদের কাজের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। শুধু কাজ নয়, খেলাধুলার মাধ্যমেও লিঙ্গ সমতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তবে তার জন্য সবাইকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। উন্নত করতে নারীদেরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতা।

বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি একজন নারীও হতে পারেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, পাইলট, জজ-ব্যারিস্টার, ডিফেন্স (আর্মি, পুলিশ, এয়ার ফোর্স, নেভি) এসব প্রফেশনেও নিজেদের জায়গা তৈরি করতে সক্ষম। এ ছাড়াও ডিজিটাল যুগে এসে, ইনফ্লুয়েন্সার, ফ্যাশন ডিজাইনার, কৃষিখাত— বিভিন্ন খাতে নিজেদের অবদান তুলে ধরছেন নারীরা। তবে কেন আমরা তাদের এগিয়ে যেতে সহায়তা করতে পারি না কিংবা করতে চাই না।

আমাদের চারপাশে এখনও দেখা যায় বাল্যবিবাহের তোড়জোড়। সুযোগ পেলেই যেন গরিব ঘরের বাবা-মায়েরা অল্প বয়সেই কন্যাসন্তানদের বিয়ে দিয়ে দায় থেকে মুক্তি পেতে যায়। বিয়ে দিলেই কি আদৌ মুক্তি পায় সেসব বাবা-মায়েরা। না, কখনোই। কারণ, শুধু বাল্যবিবাহ নয়, যৌতুকের প্রচলনও এখনও বিদ্যমান রয়েছে। তাই বিয়ে দিয়েই খ্যান্ত হতে পারেন না অসহায় বাবা-মায়েরা।

যেখানে কন্যাসন্তানকে বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে চান তারা, সেখানে বিয়ের পর যেন তাদের দায় আরও বেড়ে যায়। আটকা পড়েন যৌতুকের বেড়াজালে। আর মেয়ের স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির মানুষজন যৌতুক না পেলেই শুরু যায় স্ত্রীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন। এমন কি হত্যার মতো ঘৃন্য অপরাধও করে বসেন তারা। যার সংবাদগুলো প্রতিনিয়তই দেখতে পাই আমরা খবরের কাগজে। স্ত্রীরা স্বামীর সঙ্গে সুখে সংসার করার বদলে হয়ে যান খবরের শিরোনাম।

শুধু তাই নয়, পড়াশোনার গণ্ডি পেরোনোর আগেই, খেলার মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর আগেই সংসারে মনোনিবেশ করতে হয় অল্প বয়সেই। এমনকি অনেক সময় অভাবের সংসারের ঘানী টানতেও নারীদের নামতে হয় কাজের খোঁজে। কিন্তু প্রতিটা ক্ষেত্রেই দেখা যায় লিঙ্গ বৈষম্য। সব জায়গাতেই পুরুষদেরই বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। অধিকাংশ সময়েই এটাই তুলে ধরা হয়, নারীরা পারবে না।

সমাজে এখনও লিঙ্গ বৈষম্য থাকলেও, বর্তমানে নারীরা নিজ উদ্যোগেই এগিয়ে যাচ্ছে। তবে দরকার তাদের উৎসাহ, সাপোর্ট আর ভালোবাসা। লিঙ্গ বৈষম্য বিশ্বের সমস্ত সমাজেই প্রচলিত এবং এর বহিঃপ্রকাশ বহুমাত্রিক। চাকরির অভিজ্ঞতা, শিক্ষার সুযোগ বা স্বাস্থ্য, সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়। আর এই লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিভিন্ন কারণ উপস্থাপন করা হয়েছে।

জৈবিক সরলীকরণ বা লঘুকরণ এবং বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজে একজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতা তার জৈবিক, শারীরিক বা মানসিক দিক থেকে জন্মগত যে লৈঙ্গিক পার্থক্য, তার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্ট বৈষম্যমূলক মনোভাব বা আচরণ দ্বারা নির্ধারিত হয়। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাধারণত দাবী করা হয় যে, বিভিন্ন সমাজে কৃত্রিমভাবে নির্মিত রীতিনীতি ও প্রথার কারণে ভিন্ন লিঙ্গের ব্যক্তিদেরকে ভিন্ন ভিন্ন বা অসম ভূমিকা পালন করার জন্য দলে ভাগ করে ফেলা হয়।

লৈঙ্গিক বৈষম্য সমাধান করার জন্য কোনো সংগঠনের নীতি নির্ধারণ পর্যায়ে ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে লৈঙ্গিক প্রশ্ন বা বিষয়গুলি মাথায় রাখা হয়। সাধারণত দুই দিক থেকে সমতা আনয়নের চেষ্টা করা হয়।

একদিকে লিঙ্গ নির্বিশেষে সম্পদ ও সুযোগের সমান লভ্যতা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ প্রণোদনা বা সুবিধা প্রদান করা হতে পারে। অন্যদিকে এমন শর্ত বা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হতে পারে, যাতে লিঙ্গ নির্বিশেষে সমান ফল পাওয়া যায়। দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিরই ভালো-মন্দ দিক আছে।

বর্তমান বিশ্বে লৈঙ্গিক বৈষম্যের সাথে নারীর অধিকারের ব্যাপারটি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বিশ্বজুড়ে নারী ও নাবালক মেয়েদের অনেক ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের শিকার হতে হয়, যার মধ্যে পাচার, নারীহত্যা, যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা এবং অন্যান্য নিপীড়নমূলক কৌশল অন্তর্ভুক্ত।

এগুলোকে নির্মূল করলে লৈঙ্গিক বৈষম্য অনেকখানি দূর হবে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল বিবৃতি দিয়েছে যে ‘যদিও বহুসংখ্যক আন্তর্জাতিক ঐকমত্য বা চুক্তিতে মানুষ হিসেবে নারীর অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তা সত্ত্বেও কার্যক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে নারীদের দরিদ্র ও নিরক্ষর হবার সম্ভাবনা এখনও বেশি।

সম্পদের মালিকানা, ঋণগ্রহণ, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের মতো ক্ষেত্রগুলিতে তাদের প্রবেশাধিকার কম। নারীরা পুরুষদের চেয়ে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হবার সম্ভাবনা কম এবং তাদের গৃহস্থালি সহিংসতার শিকার হবার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।

জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়নের যে ১৭টি লক্ষ্য স্থির করেছে, তাতে লৈঙ্গিক সমতাকে ৫ম স্থান দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি কর্তৃক প্রকাশিত মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বিশ্বজুড়ে লিঙ্গ বৈষম্য পরিমাপ করা হয়।

টেকসই উন্নতকে আরও বিকাশিত করা করার জন্য নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গ সমতা প্রচার করা জরুরী। নারী ও মেয়েদের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান ঘটানো কেবল একটি মৌলিক মানবাধিকারই নয়, এটি অন্যান্য সমস্ত বিকাশের ক্ষেত্রেও অনেক প্রভাব ফেলে।

২০০০ সাল থেকে, ইউএনডিপি আমাদের জাতিসংঘের অংশীদারদের সঙ্গে এবং বিশ্বব্যাপী যারা এই কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে মিলে জেন্ডার সমতাকে আমাদের কাজের কেন্দ্রিয় করে তুলেছে এবং আমরা কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখেছি। ১৫ বছর আগের তুলনায় এখন আরও বেশি মেয়েরাস্কুলে যাচ্ছে এবং বেশিরভাগ অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষায় জেন্ডার সমতা মানা হচ্ছে।

এই অর্জনগুলো ওপর ভিত্তি করে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) নিশ্চিত করতে চায় যে, সর্বত্র যেন নারী ও মেয়েদের প্রতি বৈষম্যের অবসান ঘটে। কিছু অঞ্চলে বেতনভুক্ত কর্মসংস্থানের অ্যাক্সেসের এখনও বৃহৎ বৈষম্য এবং শ্রমবাজারে নারী- পুরুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবধান রয়েছে। যৌন সহিংসতা এবং শোষণ, বেতন এবং গার্হস্থ্য কাজের অসম বন্টন, এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে বৈষম্যতা সবই বিশাল বাধার কারণ।

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের সর্বজনীন সেবা নিশ্চিত করা এবং মহিলাদের অর্থনৈতিক ও সম্পত্তির সমান অধিকারের প্রতিদান করা এর গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। পাবলিক অফিসে এখন আগের চেয়ে বেশি মহিলা রয়েছে, সমস্ত অঞ্চল জুড়ে আরও বেশি মহিলাদের নেতৃত্ব দিতে উৎসাহিত করতে পারলে, তা জেন্ডার সমতার জন্য নীতি ও আইন জোরদার করতে সহায়তা করবে।

আসুন আমরা সবাই মিলে লিঙ্গ বৈষম্যকে প্রতিহত করে নারী- পুরুষকে সমান ভাবে সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করি। আমাদের দেশকে আরও উন্নত করতে লিঙ্গ বৈষম্য এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। গড়ে তুলি লিঙ্গ বৈষম্যহীন এক সোনার বাংলাদেশ।

বার্তাবাজার/এম আই