ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে গরীবের “রাজ প্রসাদ” খ্যাত ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর।
মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, পারিবারিক নিরাপত্তা ও রুচিবোধের পরিবর্তনের কারনে মানুষ এখন আর মাটির ঘরে থাকতে চায় না। স্বচ্ছল মানুষের এখন পাকা দালানের মধ্যেই থাকতে স্বস্তিবোধ করেন। এতে করে দ্রুতই বিলুপ্ত হচ্ছে মাটির ঘর। মাটির ঘরের স্থানে শোভা পাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন ইমরাত।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় ভারতীয় সীমান্তঘেষা বিজয়নগর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়নেই বেশীর ভাগ বাড়িতে ছিলো মাটির ঘর। কিন্তু মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কারনে ওইসব বাড়িতে মাটির ঘরের জায়গায় শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন ডিজাইনের পাকা দালান। উপজেলার প্রবীন মানুষেরা জানান, এক সময় উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর, কালাছড়া, বক্তারমোড়া, ছতরপুর, দুলালপুর, পত্তন ইউনিয়নের আদমপুর, শ্রীপুর, হরষপুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া, পাঁচগাও, বাগদিয়া,হরষপুর, সোনামোড়া, বড়চাল, মেঘশিমুল, পাহাড়পুর ইউনিয়নের খাটিঙ্গা,মকুন্দুপুর, দাড়িয়াপুর, কামালমোড়া, সেজামোড়া, ভিটি দাউদপুর, দুরানাল, কচুয়ামোড়া, সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের মেরাশানী,রানুর বাজার, আলীনগর, কাঞ্চনপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের বেশীর ভাগ মানুষের বাড়িতেই ছিলো মাটির ঘর। বর্তমানে ওইসব গ্রামের হাতেগোনা কিছু বাড়িতে মাটির ঘর থাকলেও অধিকাংশ বাড়িতে শোভা পায় দালান ঘর ও সেমি-পাকা টিনের ঘর।

এলাকাবাসী জানান, উপজেলার যে সব গ্রামে লাল মাটি ও এটেল মাটি পাওয়া যেতো সেইসব গ্রামের লোকজনই বাড়িতে মাটির ঘর তৈরী করতো। প্রথমে লাল মাটি ও এঁটেল মাটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে প্যাক করা হতো। পরে সেই মাটি দিয়ে তৈরী করা হতো ২০/৩০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল। প্রতিবার ১/২ ফুট উচু করে দেয়াল তৈরি করে সেই দেয়ালকে ৫/৬ দিন রোদে শুকানো হতো। তারপর এই দেয়াল আবারো ১/২ ফুট উঁচু করে শুকানো হতো। এভাবে পর্যায়ক্রমে ১০/১২ ফুট উচু দেয়াল নির্মান করা হতো। পরে এই দেয়ালের ওপর টিনের চালা বা ছন দিয়ে চালা (ছাউনি) দিয়ে ঘর নির্মান করা হতো। প্রতিটি ঘর নির্মান করতে সময় লাগতো প্রায় ২/৩ মাস। পরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘরের ভেতরের দিকে ধানের তুষ (কুড়া) দিয়ে দেয়ালের উপর প্রলেপ দেয়া হতো। বাইরের দিকে দেয়া হতো চুনের প্রলেপ বা আলকাতরা। চুনের প্রলেপ দিলে ঘরের সৌন্দর্য যেমন বৃদ্ধি পেত, তেমনি

ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকেও মাটির দেয়াল রক্ষা পেত। বন্যা বা ভূমিকম্প না হলে এসব ঘর ২০/২৫ বছর পর্যন্ত টিকে থাকতো। যারা মাটির ঘর নির্মানের কারিগর ছিলেন তাদেরকে বলা হতো দেয়ালী। উপজেলার হরষপুর ইউনিয়নের নিদারাবাদ গ্রামের দেয়ালী নোয়াজ আলী জানান, মাটির ঘর তৈরির উপযুক্ত সময় হচ্ছে কার্তিক মাস। কারন এ সময় বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। তিনি বলেন, আমরা প্রতি হাত ঘর নির্মানে ১০টাকা করে নিতাম। আবার অনেক সময় ৫/৬ হাজার টাকা চুক্তিতেও ঘর নির্মান করে দিতাম। তিনি বলেন, মানুষ এখন আর মাটির ঘর তৈরী করেনা যার জন্য আমরা এই পেশা ছেড়ে দিয়েছি।

উপজেলার নিদারাবাদ গ্রামের বাসিন্দা সংবাদ কর্মী এস.এম টিপু চৌধুরী বলেন, আমি ছোট বেলায় মাটির ঘরেই বসবাস করেছি। মাটির ঘরে বসবাস খুবই আরামদায়ক। গরমের দিনে ঠান্ডা আর শীতের দিনে শীত লাগতো না। তিনি বলেন, আমাদের বাড়িতে ৭টি বড় বড় মাটির ঘর ছিলো। বর্তমানে একটি ঘর ছাড়া বাকি ঘরগুলো ভেঙ্গে সেখানে পাকা দালান নির্মান করা হয়। বাড়ির ঐতিহ্য হিসেবে এখনো প্রায় শতবর্ষ পুরনো একটি মাটির ঘর রাখা রয়েছে। তিনি বলেন, গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে এই মাটির ঘরটিকে আমরা রেখে দেব।

উপজেলার পাহাড় ইউনিয়নের বাসিন্দা ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোঃ রাসেল খান বলেন, আমি এখনো মাটির ঘরেই বসবাস করি। তিনি বলেন, মাটির ঘরে বসবাস করা খুবই আরামদায়ক। গরমের দিনে ঠান্ডা আর শীতের দিনে ঘরে গরম অনুভুত হয়। তিনি বলেন, আমাদের বাড়িতে ৫টি মাটির ঘর ছিলো। এখন আমার বাড়িতে দুটি মাটির ঘর আছে। বাকি গুলো ভেঙ্গে পাকা দালান নির্মান করা হয়েছে। রাসেল খান বলেন, আগে আমাদের এলাকার বেশীর ভাগ মানুষের বাড়িতেই মাটির ঘর ছিলো। এলাকার অনেকে মানুষই বিদেশ গিয়ে এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হয়েছেন। প্রবাসীরা দেশে এসে পারিবারিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ও বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য মাটির ঘর ভেঙ্গে পাকা দালান নির্মান করছেন। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কারনে মানুষ এখন আর মাটির ঘরে বসবাস করতে চায়না।

উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের খাটিঙ্গা গ্রামের রফিক মিয়া বলেন, আগে আমাদের গ্রামের প্রতি বাড়িতেই মাটির ঘর ছিলো। বর্তমানে মাটির ঘরের সংখ্যা খুবই কম। তিনি বলেন, লাল মাটি ও এঁটেল মাটির অভাব, মাটির ঘর তৈরী করার কারিগর সংকটের কারনেও মানুষ এখন মাটির ঘর নির্মান করতে চায়না। এছাড়া গ্রামের লোকজন বিদেশে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হয়েছেন। প্রবাসে থেকে তাদের রুচিবোধেরও পরিবর্তন হচ্ছে। প্রবাসীরা দেশে এসে তাদের পরিবারের নিরাপত্তা ও বাড়ির সৌন্দর্যের কথা ভেবে মাটির ঘর ভেঙ্গে বিভিন্ন ডিজাইনের পাকা দালান, বহুতল বিশিষ্ট ভবন নির্মান করছেন। তিনি বলেন,
বাড়িতে একটি পাকা দালান থাকাটা অনেকেই স্ট্যাটাসের অংশ হিসেবে মনে করেন।

এ ব্যাপারে বিজয়নগর উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউল হক বকুল বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে মানুষের আয়-রোজগার বেড়েছে। এছাড়াও বিদেশে গিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মানুষের রুচিবোধ সামাজিক মর্যাদাবোধও বড়েছে। তাই মানুষ এখন আর মাটির ঘরে বসবাস করতে চায়না। ফলে মাটির ঘর ভেঙ্গে পাকা দালান নির্মান করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বেড়েছে। আয়-রোজগার বাড়ার সাথে সাথে মানুষের মধ্যে সামাজিক মর্যাদাবোধ বেড়েছে। মানুষ এখন নিজের পরিবারিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশী সচেতন। তাই মানুষ এখন আর মাটির ঘরে বসবাস করতে চায়না।

বার্তাবাজার/রাহা