ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা ছিল প্রখর । মায়ের বানানো কাঠের ব্যাট দিয়ে ক্রিকেটে হাতেখড়ি। তারপর সময় পেরিয়ে বয়স যখন ৮ তখন বাসায় ছিল সাদাকালো টেলিভিশন। তখন ভারত-পাকিস্তানের খেলা দেখাতো বাংলাদেশ টেলিভিশনে। তাই দেখে ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁকটা আরও বাড়ল। রোজেলের বাবা লেখাপড়া নিয়ে বেশ করাকরি ছিলো বিধায় বাসায় তখনও ডিশ ছিলো না। ডিশ না থাকলেও তাঁর কারিগরি বুদ্ধি কম ছিলো না। পাশের বাসার ডিশের তারের উপর তাঁর বাসার টিভির এন্টেনার দুই প্রান্তে লাগানো তার লাগিয়ে দিল। হালকা আবছা আবছা করে টেন স্পোর্টস চ্যানেল টা এসেছিলো তখন দেখলেন অস্ট্রেলিয়া ব্যাটিং করছে। অস্ট্রেলিয়ার খেলা দেখে তাঁর বেশ ভালই লাগলো তখন সিদ্ধান্ত নিলেন অস্ট্রেলিয়াকেই সাপোর্ট করবেন।

ছোটবেলায় ভাল ক্রিকেট খেলার জন্য শারিরিক শিক্ষা শিক্ষক মাসুম স্যার তাঁকে সিলেক্ট করলেন। জিলা স্কুল টিমের জন্য পাঠালেন ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসের অলক (কোচ) দার কাছে। কিন্তু তাঁর বাবার কথা পড়ালেখা ঠিক রেখে খেলতে হবে। তিনি তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ক্লাস এবং প্র্যাকটিস করে এসে আর লেখাপড়া করার মতো শক্তি থাকতো না, বাসায় এসেই ঘুমিয়ে পড়তেন। তাঁর বাবা তাঁকে আর প্র্যাকটিসে যেতে দিলেন না। সেই সাথে তাঁর ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে ক্যাডেটে ভর্তির জন্য রোজেল ইংরেজি পড়তেন হাবুল স্যারের কাছে। হাবুল স্যার মাঝে মাঝে ইংরেজিতে ক্লাস নিতেন। তাই দেখে তাঁর ইংরেজির প্রতি ভালবাসা জন্মালো। তিনি বাসায় নিজে নিজে, আয়নার সামনে দাড়িয়ে এবং রাস্তায় চলতে ফিরতে ইংরেজি প্র্যাকটিস করতেন। প্রথমে অনেক ভুল বলতেন, কখনো ভুল অর্থ হত, কখনো ভুল কালের প্রয়োগ করতেন। কিন্তু তিনি হাল না ছেড়ে ধৈর্যের সাথে প্র্যাকটিস করতে থাকলেন। সাথে অস্ট্রেলিয়ার সমর্থক হওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার ধারাভাষ্যকারদের ধারাভাষ্য শুনে আরও প্র্যাকটিস করতে লাগলেন। যখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্র তখন তাঁর এলাকার এক বড় ভাই তাঁকে নিয়ে গেলেন নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার একটা টুর্নামেন্টে ধারাভাষ্য দেওয়ার জন্য। সেখানে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, চেয়ারম্যানসহ আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ। অনেকেই প্রশংসা করলেন আবার অনেকেই বললেন ইংরেজিতো অনেকেই বুঝে না বাংলায় করলে ভালো হতো কিন্তু তখনও রোজেল বাংলা ধারাভাষ্য পারতেন না যেহেতু তিনি ইংরেজি ধারাভাষ্যই শুনে শুনে শিখেছেন।

এই বছরেই তিনি স্পেলিং বী, বাংলাদেশ নামক এক প্রতিযোগিতায় জোনাল রাউন্ড থেকে নির্বাচিত হয়ে ডিভিশনাল রাউন্ডে টপ ৫৪ জনের মধ্যে থেকে প্রতিযোগিতা শেষ করেন। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে নটর ডেম কলেজ ইংলিশ ক্লাব আয়োজিত ন্যাশনাল ইংলিশ কার্নিভালে রোজেল উপস্থিত বক্তৃতায় ২য় এবং দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতায় ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের হয়ে ১ম হন। ২০১৩ সালে দশম শ্রেণিতে থাকাকালীন শারিরিক শিক্ষা শিক্ষক কাশেম স্যার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ইংরেজিতে উপস্থাপনা করার সুযোগ করে দিলেন। আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনাল ম্যাচে তাঁর হাতে মাইক তুলে দিলেন কাশেম স্যার। কলেজে উঠার পর আন্তঃকলেজ ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনাল ম্যাচেও তিনি ইংরেজিতে ধারাভাষ্য দিয়ে অনেকের প্রশংসা অর্জন করলেন। সেসময় ময়মনসিংহ প্রিমিয়ার লীগে তাঁর স্কুলের সিনিয়র ভাই ২০০০ ব্যাচের আরিফুর রহমান রবিন ধারাভাষ্যের সুযোগ করে দেন।

২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো “ফ্রেশ প্রেজেন্টস;স্বাধীন কমেন্টেটর হান্ট অরগানাইজড বাই রেডিও স্বাধীন”। সারাদেশের টপ ৩৫ জনের একজন ছিলেন রোজেল। সেখান থেকে ভয়েজ অব আমেরিকা বাংলাদেশের সাংবাদিক অমৃত মলঙ্গির সাথে পরিচয় হয়। যার সহায়তায় ২০১৮ সালের নভেম্বেরে তৎকালীন “লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডস বাংলাদেশ” এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর রিফাতুল ইসলাম, হাসিব আহমেদের মাধ্যমে প্রফেশনাল কমেন্ট্রিতে সুযোগ পান তিনি।

এরপর ২০১৯ শালের ৩০ মে তে শুরু হওয়া “আইসিসি ক্রিকেট বিশকাপ ২০১৯” এ বাংলা ধারাভাষ্যে রেডিও এবিসিতে তিনি সুযোগ করে নেন।

করোনা শুরু হওয়ার পর অনেকদিন তাঁর ধারাভাষ্য বন্ধ থাকে। ধারাভাষ্য বন্ধ থাকলেও তখন তাঁর স্কুল ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের এলামনাই এসোসিয়েশনের কর্মকান্ডে নিজের সরব উপস্থিতির জানান দেন আর এলামনাই এসোসিয়েশনে তাঁকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ১৯৯৫ ব্যাচের সিনিয়র ভাই শামসুল আলম উজ্জল। তারপর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রোজেল যোগ দেন রেডিও ভুমিতে। অনেকদিন কাজ করার পর ২০২১ এ আবারো লকডাউন থাকায় ধারাভাষ্যে বিরতি পরে যায়। এ বছরই তিনি স্কুলের সিনিয়র ভাই ১৯৯৫ ব্যাচের আরিফ চৌধুরী রাসেল এবং শরীফুজ্জামান সোহেল ভাইয়ের মাধ্যমে তাঁর নিজের স্কুলের “থার্ড এমজেডএস এলামনাই ক্রিকেট টুর্নামেন্ট অরগানাইজড বাই এমজেডএস এক্স স্টুডেন্টস স্পোর্টস ক্লাব” এ ধারাভাষ্য দিয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেন।

২০২১ এর অক্টোবরে “টিস্পোর্টস হান্ড্রেড বলস কর্পোরেট ক্লেশ” টুর্নামেন্টে সুযোগ পান। তারপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে ওয়াল্টন কর্পোরেট টি টুয়েন্টি টুর্নামেন্ট অর্গানইজড বাই টিকে স্পোর্টস, লাইফ স্প্রিংস ডমিনেটরস কাপ, বঙ্গবন্ধু ফোর নেশন্স ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, প্র বক্সিং দি আলটিমেট গ্লোরি, ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগ, বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপ, হকি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, বসুন্ধরা কিংস ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ এ ধারাভাষ্য দিয়ে ক্রীড়া মহলে বেশ পরিচিতি লাভ করেন। ২০২১, ২০২২ এবং ২০২৩ সালে টানা তিনবার তিনি “বিজিএমইএ কাপ” ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলোয়াড়দের নিলাম পরিচালনা করেন।

যে স্বপ্ন ছোট বেলা থেকে তিনি দেখতেন একদিন আন্তর্জাতিক ধারাভাষ্যকার হবেন সেই দিনটা আসলো ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ “বাংলাদেশ উইমেন বনাম অস্ট্রেলিয়া উইমেন” টি-টোয়েন্টি সিরিজে । আর এই সুযোগটা করে দেন অস্ট্রেলিয়া ট্যুর অব বাংলাদেশের ব্রডকাস্টার “সাইলেন্ট মিডিয়া” এর সিইও রবি হোসাইন নীরব এবং প্রখ্যাত ধারাভাষ্যকার কুমার কল্যান। এই সিরিজের ২টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে রোজেল ধারাভাষ্য দেন। ভবিষ্যতে মেন্স ইন্টারন্যাশনাল, আইসিসির টুর্নামেন্টসহ অ্যাশেজ সিরিজে ধারাভাষ্য দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

বার্তা বাজার/এইচএসএস