শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত কুমিল্লার দেবীদ্বারের প্রত্যন্ত মুগসাইর গ্রাম। বই-খাতা হাতে নিয়ে মনের আনন্দে ছুটে চলছেন নানান বয়সের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা; লক্ষ্য এক ঘণ্টার স্কুলের দিকে।

আশপাশের গ্রামের হত দরিদ্র ঘরের প্রাথমিক পর্যায়ের শিশু-শিক্ষার্থীরা কুমিল্লায় শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে এক ঘণ্টার স্কুলটিতে গিয়ে। কারও হাতে বেলুন, কারও হাতে চকলেট আর উপহারের খাতা-কলম। প্রতিষ্ঠানটিতে যাওয়া আসা ১ ঘন্টা সময় থাকা পরস্পর পরস্পরের যেন আত্মীয়ের বন্ধন অন্যরকম স্বাদের আনন্দে ভাসছে শিক্ষার্থীরা।

কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার ইউছুফপুর ইউনিয়নের মুগসাইর গ্রামে এক ঘণ্টার স্কুলে গিয়ে দেখা যায় এমন দৃশ্যের।

প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেল, ২০২০ সালের শেষের দিকে মুগসাইর গ্রামের তরুণদের উদ্যোগে ‘ভালবাসার ঘর’ নামে একটি সেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর উদ্দেশ্য ছিল সমাজে অসহায় ঘরহীন ব্যক্তিদের অর্থ সহ নতুন ঘর প্রদান করা। এরই আলোকে গ্রামের ভুমিহীন দের একে একে ৬টি ঘর প্রদান এবং বহু মানুষকে আর্থিক সহায়তা করা হয়।

ফেব্রুয়ারী’ ২৪ থেকে শিক্ষা কর্মসূচি হাতে নেয় এ সেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনটি। স্থানীয়দের সহায়তায় ’১ ঘণ্টার স্কুল’ নামে মুগসাইর লাইফ মডেল কিন্ডারগার্টেন স্কুল উদ্বোধন করা হয় স্থানীয় সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য।

উদ্বোধনের পর ব্যতিক্রমী এই স্কুলে প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত চলে পাঠদান। নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি গণিত ও ইংরেজিতে দক্ষ করে গড়ের তোলা হচ্ছে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। এখানে শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ৬ জন শিক্ষার্থী। স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাপক প্রশংসা কুঁড়িয়েছে স্বতন্ত্র এই প্রতিষ্ঠান। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের পাড়ালেখায় মনোযোগী করতে বেলুন, চকলেট ও খাতা-কলম উপহার দেওয়া হয়। এতে খুশি অভিভাবকরাও। প্রত্যন্ত গ্রামে শহরের আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা বিনামূল্যে শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় তরুণ উদ্যোক্তাদের।

এ বিষয়ে মুগসাইর এগারো গ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ শিক্ষার্থীরা ১ ঘণ্টার যে স্কুল উদ্বোধন করে তারা সফল হয়েছে। হতদরিদ্র পরিবারের যে সমস্ত ছেলে-মেয়েরা ১ হাজার কিংবা ২ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট পড়তে পারছে না, তারা এখানে বিনামূল্যে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেয়ে আনন্দিত।

এলাকার সেচ্ছাসেবক আজওয়াদ হোসেন তাহসিন বলেন, বিনামূল্যে স্কুল ও মাদরাসার শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে এটি প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। তারা মুগসাইর গ্রামের শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। আমি তাদের সফলতা কামনা করছি।

এক ঘণ্টার স্কুলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ শরীফ বলেন, আমাদের ভালবাসর ঘর সামাজিক একটি সংগঠন। স্থানীয় এবং প্রবাসীদের সহায়তায় সমাজে নানা রকম ভালো কাজ করে থাকি। তারই অংশ হিসাবে এক ঘণ্টার স্কুল স্থাপন করেছি। তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন বিকেলে ১ ঘণ্টা সময় দিয়ে থাকি। সেখানে পড়ানো হয় গণিত ও ইংরেজিসহ মানবিক বিষয়গুলো। বর্তমানে আমাদের এই স্কুলে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। আমার বিশ্বাস সুবিধা বঞ্চিত এই শিশুরা একদিন বাংলাদেশ তথা মুগসাইর গ্রামের সুনাম বয়ে আনবে। এই প্রত্যাশা থেকেই আমরা এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি।

কুমিল্লা (৪) দেবীদ্বার আসনের সংসদ সদস্য ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে এরকম উদ্যোগ সত্যি প্রশংসনীয়। সরকারের পক্ষ থেকে আমি স্কুলটির জন্য আমি অর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করব।

দেবীদ্বার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নার্গিস সুলতানা বলেন, স্কুলটি সম্পর্কে আমি আপানার কাছ থেকে শুনেছি। আমি খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত জানাব। তাদেরকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকারি অনুদানের সুযোগ থাকলে ব্যবস্থা করব।

দেবীবার ইউছুফপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাকারিয়া বলেন, মুগসাইর গ্রামের কিছু উদ্যোমী তরুণ শিক্ষার্থী এক ঘণ্টার স্কুল চালু করেছে। বিনামূল্যে তারা শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এতে তারা শিক্ষার মান উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে বলে আমি মনে করছি। এটি পরিচালনা করতে কোনো ধরণের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আমার পক্ষ থেকে যতটুক সম্ভব সহায়তা করার চেষ্টা করব।