শরীয়তপুর গোসাইরহাটে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ডাক্তারের অবহেলা, অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক ও আইসিইউ না থাকায় ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে দুই নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার সত্যতা পেয়ে হাসপাতালটি বন্ধ করে দিয়েছে শরীয়তপুর জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। শরীয়তপুর সিভিল সার্জন ডা. আবদুল হাদী মো.শাহপরান মঙ্গলবার (৫ মার্চ) বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত সোমবার গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া ইউনিয়নের লক্ষীপুর গ্রামে হাবিবুর রহমান আজাদ এর স্ত্রী নাদিয়ার প্রসব বেদনা নিয়ে বিকেল পোনে পাঁচটায় জরুরি সেবা ও সিজারের জন্য ঢালী ডিজিটাল ডায়গনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পরে রাতে ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসক দিয়ে এনেস্থিসিয়া প্রয়োগ করে গৃহবধূর সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর বাচ্চা ভালোই ছিল। তবে বাচ্চা শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া ওটিতে থাকা নার্স ও ডাক্তার মিলে নবজাতকের বুকে সিবিসি প্রয়োগ করতে থাকে। এভাবে নবজাতকটিকে প্রায় আধা ঘণ্টা চাপতে থাকে। তাদের অতিরিক্ত চাপের কারণে নবজাতকের বুকের এক পাশ নিল হয়ে যায়। পরে তারা উপায় না পেয়ে তড়িঘড়ি করে বাচ্চাটি সদরে প্রেরণ করেন। সদর হাসপাতালের ডাক্তার বলেন এ রোগী আমরা রাখতে পারবো না, এ কে দ্রুত ঢাকা নিয়ে যান। এম্বুলেন্স যোগে ঢাকা নেয়ার পথে নবজাতকের মৃত্যু হয়।

এছাড়াও গত ৪ মার্চ রোববার একইভাবে উপজেলার গোসাইরহাট ইউনিয়নের খাট্রা গ্রামের আলআমিন মাঝির স্ত্রী সন্তান সম্ভবনা রেখা আক্তার এর সদ্য নবজাতক সিজার পরে মারা যাওয়ার অভিযোগ ওঠে।

গাইনী সার্জন ডা: সৈয়দা শাহিনুর নাজিয়ার বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ করেন চম্পা নামের এক গৃহবধূ। তিনি বলেন, আমার দ্বিতীয় সন্তান প্রসবের সময় ডা: নাজিয়ার কাছে যাই। তিনি আমার সিজার করেন। সে আমার সিজারের স্থানটি সেলাই না করে খাওয়া দাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে যায়। এদিকে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে মরার উপক্রম হয়। আমি তাদের কে বললে, তারা দ্রুত আমার সেলাইয়ের ব্যবস্থা করেন। তবে তারা প্রায়সময় অনভিজ্ঞ নার্স দিয়ে সেলাই করে আমাদের সর্বনাশ করেন। তাই আমরা দেখি পেটের ভিতরে গজ কাপড়, ব্লেড ও কাঁচি রেখেই সেলাই করে দেয়।

নবজাতকের নানা মো. আবু তাহের বলেন, আমি আগেই ওদের বলছিলাম তোমরা এই হাসপাতালে আমার মেয়ের সিজার করিওনা। কারন এ হাসপাতালে কিছু দিন আগে আমার এক আত্মীয়ের এক নবজাতক মারা গেছে। তোমরা আমার কথা না শুনে এখানে রেখে আমার নানা ভাই কে মেরে ফেলেছে। আমি এর সঠিক বিচার চাই। আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম তিনি এর বিচার করবেন। তিনি আরও বলেন এ অজপাড়া গাঁয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল খুলে শুধু মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওদের কঠিন বিচার না হলে ওরা ঠিক হবে না।

নবজাতকের বাবা হাবিবুর রহমান আজাদ বলেন, আমার সন্তান সিজারের পরে ভালো ছিল। কান্নার শব্দও আমরা শুনেছি।
তারা আমার সন্তান কে আমার কাছে না দিয়ে তার নরম বুকের মধ্যে অনবরত চাপ দিতে থাকে। আধা ঘণ্টা চেপে জখম করে বলে আমরা এখানে কিছু করতে পারবোনা। আপনারা ওকে আইসিইউ তে নিয়ে যান।

এরপর আমি আমার বাচ্চা নিয়ে যেখানেই গিয়েছি সবাই বলছে বাচ্চার এ কি অবস্থা করেছেন, আমরা এর চিকিৎসা করতে পারবো না। তাই ওকে ঢাকা নিয়ে যান। ঢাকা নেয়ার পথে এম্বুলেন্সেই আমার সন্তানটি মারা গেল। আমি বাবা হয়ে কিছুই করতে পারলাম না। আমি ওদের বিচার চাই আমার মতো আর কারো সন্তানের যেন এমন মৃত্যু না হয়।

ঢালী ক্লিনিকের কর্মচারি মোশাররফ বলেন, আমাদের এখানে কোন বাচ্চা মারা যায়নি। সিজারের পরে বাচ্চা দুটির পালস কমে যাচ্ছে দেখে আমরা একজনকে গোসাইরহাট ও অপর জনকে সদর হাসপাতালে প্রেরণ করি। পরে বাচ্চা দুটি ঐ খানে মারা যায়। সিভিল সার্জন আমাদের ক্লিনিকে এসে আমাদের ক্লিনিক বন্ধ রাখতে বলেন। এবং রোগিদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে বলায় আমরা এখন ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি।

গাইনী সার্জন ডা: সৈয়দা শাহিনুর নাজিয়া তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি রোগীকে সিজার করার পূর্বে সকল প্রকার পরিক্ষা নিরিক্ষা করে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রোগীর অপারেশনও সফল ভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। নবজাতক ও তার মা উভয়েই সুস্থ ছিল। কিভাবে এমন হলো তা আমার বোধগম্য না। তাছাড়া আমি হলাম নবজাতকের মায়ের ডাক্তার। নবজাতকের ডাক্তার আলাদা। এবিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আরও ভালো বলতে পারবে। নবজাতক মৃত্যুর বিষয়টি আমি মাত্র আপনাদের নিকট হতে জানতে পারলাম।

শরীয়তপুর সিভিল সার্জন ডা. আবদুল হাদী মো.শাহপরান বলেন, ঢালী ডিজিটাল ডায়গনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ম বহির্ভূত কর্মকান্ডে দুটি নবজাতক মারা যাওয়ার অভিযোগে হাসপাতালের সকল কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। তিন সদস্য বিসিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্যদিবসে মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।