কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে ভেসে আসছে একের পর এক মৃত সামুদ্রিক কাছিম। চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে এই পর্যন্ত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ইনানী, হিমছড়ি, সোনারপাড়া ও সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে ২৮টি মৃত কাছিম উদ্ধার করা হয়েছে। প্রতিটি মা কাছিমের পেটে ডিম ছিলো। এছাড়া চলতি মাসে ৩টি মৃত ডলফিন ভেসে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে কাছিম সংরক্ষনে যুগ যুগ ধরে কাজ করা বেসরকারী সংস্থা গুলোর কর্মকান্ড নিয়ে। সামুদ্রীক এসব প্রানী রক্ষায় চলতি বছর থেকে নতুন করে প্রকল্প শুরু করেছে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বোরি)।

বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বোরি) বৈজ্ঞানীক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম ‘বার্তা বাজার’কে জানান, আমাদের তথ্য অনুযায়ী কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন থেকে সোনাদিয়া দ্বীপ পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকা এখনো পর্যন্ত দূষণ মুক্ত আছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ‘অক্টোবর থেকে এপ্রিল’ পর্যন্ত সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন মৌসুম। এ সময়ে সৈকতের বালিয়াড়ীতে ডিম পাড়তে আসার সময় জেলেদের জালে আটকা পড়ে বা মাছ ধরার নৌকা বা ট্রলারে আঘাত প্রাপ্ত হয়েই কাছিম গুলো মারা যায়।

বোরি সূত্র বলছে, জানুয়ারিতে ১৯টি এবং ফেব্রুয়ারিতে ৯টি অলিভ রিডলি মা কাছিম মৃত অবস্থায় কক্সবাজার উপকূলে পাওয়া গেছে। ভেসে আসা কাছিম গুলো অলিভ রিডলি প্রজাতির ‘মা’ কাছিম। প্রতিটি কাছিমের পেটে ৮০ থেকে ৯০টি ডিম পাওয়া গেছে। সর্বশেষ ১৮ ফেব্রুয়ারী উদ্ধার হওয়া কাছিমের পেটেও ৯০টি ডিম পাওয়া গেছে। উদ্ধারকৃত কাছিমের ডিমগুলো বোরিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়াও ফেব্রুয়ারিতে ১টি ইন্দোপ্যাসিফিক ফিনলেস পোর্পোইস, ২টি ইরাবতী ডলফিন এবং ১টি ইন্দোপ্যাসিফিক হ্যাম্পব্যাক ডলফিন মৃত অবস্থায় কক্সবাজার উপকূলে পাওয়া গেছে।

সূত্রটি আরো জানায়, পৃথিবীতে মোট ৭ প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম পাওয়া গেলেও বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় দেখা মেলে তিন প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম। এদের মধ্যে অলিভ রিডলি কাছিমের প্রাপ্যতার হার ৯৮%, গ্রীন সী টার্টেল ১% এবং হক্সবিল সে টার্টেল ১% এর মত হতে পারে। শুধু মাত্র চলতি বছর ৭৪ টি অলিভ রিডলি ‘মা’ কাছিম থেকে প্রায় ৮ হাজার ৯৫০টি ডিম পাওয়া গেছে। এগুলো কক্সবাজারের সোনারপাড়া, শীলখালী, মাদারবুনিয়া, পেচারদ্বীপ, শামলাপুর, সেন্টমার্টিন কাছিম হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কাজগুলো করছে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, কোডেক USAID- ন্যাচার এন্ড লাইফ প্রজেক্ট, নেকম এবং পরিবেশ অধিদপ্তর।

তরিকুল ইসলাম আরো জানান, বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. তৌহিদা রশীদের নির্দেশে বোরির একটি গবেষণা টিম কাছিম ও ডলফিনের বর্তমান অবস্থা, প্রতিবছর কতগুলো কাছিম ডিম পাড়তে আসে, কতগুলো ডিম পারে, কতগুলো ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়ে সমুদ্রে অবমুক্ত করা হয়, কতগুলো মা কাছিম মারা যায়, মারা যাওয়ার কারণ জানা এবং কিভাবে তাদের কে সংরক্ষণ করা যায় তা নিয়ে চলতি বছর থেকে গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।

এদিকে কাছিম সংরক্ষন নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে কাজ করছে নেচার কনজারভেশন ম্যানেজম্যান্ট (নেকম)। কাছিম মৃত্যু কারন মৃত্যু হ্রাস করার উপায় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে নেকম এর সহকারী প্রকল্প ব্যবস্থাপক আব্দুল কাইয়ুম জানান, অধিকাংশ কাছিমের মৃত্যু হয় গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার বড় ট্রলার গুলোর জালে আটকা পড়ে। কখনো শ্বাস নালীতে পলিথিন আটকে যাওয়া ও সৈকতে ডিম ছাড়তে এসে বেওয়ারিশ কুকুড়ে আক্রমনে কাছিম এর মৃত্যু হয়।

তিনি আরো জানান, মৃত্যুর হার হ্রাস করতে গেলে, বিশেষ করে জেলেদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও সমুদ্র দূষন কমিয়ে আনতে হবে। এছাড়াও মাছ ধরার জাল গুলোতে ট্রাডেল এক্সক্লোজার ডিভাইস (TED) বসাতে হবে। কারেন্টজাল বন্ধে প্রশাসনকে আরো আন্তরিক হতে হবে। সৈকতে কাছিমের অভয়ারন্যে বেওয়ারিশ কুকুরের বিচরন বন্ধ করতে পারলে কাছিম নিরাপদে থাকবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাছিম সংরক্ষন নিয়ে কাজ করছে পরিবেশ অধিদপ্তর, নেকম ও কোডেক নামক দুটি বেসরকারী সংস্থা। তৎমধ্যে নেকম কাজ করছে ২০০৩ সাল থেকে ও কোডেক কাজ করছে ২০২১ সাল থেকে। এরা দ্বীর্ঘ বছর কাজ করেও বিশেষ করে উপকূলীয় জেলেদের আশানুরূপ সচেতনতা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বছরের পর বছর কাছিম মরলেও তা গণমাধ্যমে তেমন প্রচার না পাওয়ায় এসব সংস্থা গুলোর তেমন জবাবদিহিতা ছিলো না। সম্প্রতি ব্যাপকহারে মরা কাছিম ও ডলফিন উপকূল থেকে উদ্ধারের পরে বিষয়টি খবরের শিরোনাম হওয়ার পর প্রকল্প বাঁচায়ে নড়েচড়ে বসেছে এই সংস্থা গুলো।