ফরিদপুরের বোয়ালমারীর একটি শতবর্ষী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‌্যাগ ডে উদযাপন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সুনামধন্য শতবর্ষী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বোয়ালমারী জর্জ একাডেমীতে ১২ নভেম্বর রবিবার এই র‌্যাগ ডে উদযাপন করে ২০২৩ ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা।

বিদায় অনুষ্ঠানের নামে অশ্লীল র‌্যাগ ডে উদযাপনের নানা ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নানা মহলে নিন্দার ঝড় উঠে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ২০২২ খ্রিস্টাব্দে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে র‌্যাগ ডে এর নামে অবক্ষয়মূলক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‌্যাগ ডে’ উদযাপনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এতে র‌্যাগ ডে’র নামে নগ্নতা, ডিজেপার্টি, অশ্লীলতা, অবৈধ কার্যকলাপ, গুন্ডামী ইত্যাদি অনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়মূলক কার্যকালাপ করা যাবে না মর্মে নির্দেশ জারি করে মন্ত্রণালয়।

হাইকোর্ট ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. সিরাজুল ইসলাম র‌্যাগ ডে পালনের অনুমতি দিয়েছে বলে জানা গেছে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও অভিভাবক কমিটির দুই সদস্যের সার্বিক তত্বাবধানে শিক্ষক প্রতিনিধি কৃষ্ণ সাহা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে এ র‌্যাগ ডে’র আয়োজন করে বলে জানায় অংশ গ্রহণকারি শিক্ষার্থীরা।

র‌্যাগ ডে উপলক্ষে সাউণ্ডবক্সের গানের তালে তালে ছেলে মেয়েদের এক সাথে নাচনাচি করতে দেখা যায়, সেই সাথে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে ফটোসেশান ও একটি কক্ষে একটি ছেলে ও মেয়ে একান্তে মিলিত হওয়ার দৃশ্য ভিডিওতে দেখা গেছে। এছাড়া অনুভূতি ব্যক্ত করার নামে বেশ কিছু ছাত্র ছাত্রীকে একে অপরের গায়ে থাকা টিশার্টে যৌন উত্তেজক, কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল ও প্রকাশ অযোগ্য নানা শব্দ লিখে দিতে দেখা যায়। সেসব কুরুচিপূর্ণ লেখা টি-শার্ট পরে শিক্ষকদের সাথে ঘুরে বেড়াতে ও ফটোসেশান করতে দেখা অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১২ নভেম্বর রবিবার শ্রী শ্রী শ্যামাপুজার বন্ধের দিন কতিপয় শিক্ষার্থী র‌্যাগ ডে উদযাপনের পরিকল্পনা করে। এতে তারা খাওয়া-দাওয়া, টি-শার্ট ক্রয়, ফটোসেশান ও সাউণ্ড সিষ্টেম এর জন্য মাথাপিছু ৩৫০ টাকা করে চাঁদা সংগ্রহ করে। প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষক ও সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন এতে সহযোগিতা করে বলে জানায় র‌্যাগ ডেতে অংশ গ্রহণকারি শিক্ষার্থীগণ।

সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের মতপার্থক্য ও দ্বন্দ্বে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ অনুযোগে বছর জুড়েই সমালোচনার মুখে থাকা প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে র‍্যাগডে পালন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এতে শতবর্ষী বিদ্যালয়টির মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে দাবি করে অনেক অভিভাবক ও সুশীল সমাজ ।

ইতালি প্রবাসী সাংবাদিক কমরেড খন্দকার ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, যেখানে আত্মসম্মান বির্সজন দিয়ে শিক্ষকরা ল্যাংটা হয়ে রাস্তায় নেমে গ্রুপিং শুরু করেছে সেখানে শিক্ষার্থীরা র‍্যাগ ডে’র নামে নোংরামি করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। ফেসবুকে দেখলাম- কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল শব্দ লেখা টিশার্ট পরা, মুখে আবির মাখা ছেলে মেয়ের ছবি। সত্যি দুঃখজনক। এগুলো কি দেখার কেউ নেই..!!

বোয়ালমারী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কাজী হাসান ফিরোজ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের গর্বের প্রতিষ্ঠানে র‌্যাগ ডে’র নামে যে অপসংস্কৃতি ও বেহায়াপনার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে তার তীব্র নিন্দা সহ প্রতিবাদ জানাই। সেই সাথে আয়োজকদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবী জানাই।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী আল আমিন নিবিড় জানান, পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানের নামে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলে মেয়ের কর্মকাণ্ড দেখে হতবাক হয়েছি। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এই উচ্ছৃঙ্খলতার অনুমতি দিয়েছেন ভাবতেই অবাক লাগছে।

কবি নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গাজী শামসুজ্জামান খোকন বলেন, বিদায় অনুষ্ঠানের নামে ছাত্র-ছাত্রী পরস্পর নিজেদের পরিহিত টি শার্টে প্রকাশ অযোগ্য অশ্লীল লেখালেখি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি কখনোই সভ্যতার অংশ হতে পারে না। তারা আমাদের ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। বিনয়ী বিদায়ের পরিবর্তে এমন উগ্র আয়োজন আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই।

বিদ্যালয়টির অভিভাবক কমিটির সদস্য সম্পা রেজা বলেন, বর্তমান কমিটির কতিপয় সদস্য, সভাপতি ও সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে যে নোংরামি শুরু করেছে তাতে কমিটির সদস্য হিসেবে আমি লজ্জিত, ‌‌র‌্যাগ ডের যে ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তা ভাষায় ব্যক্ত করতেও আমি লজ্জা পাচ্ছি। এ ব্যর্থতা আমাদের এ জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।

সাদিদ সিয়াম নামে এক পরীক্ষার্থী দাবী করেছেন, সমস্ত আয়োজন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। সবাই মিলে আনন্দ করা দোষের কিছু না।

বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমার অনুমতি নিয়েই শিক্ষার্থীরা র‌্যাগ ডে আয়োজন করেছে। ভদ্রোচিত ভাবেই তারা আনন্দ করেছে। অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ শব্দ লেখা টি-শার্ট পরা ও ঘুরে বেড়ানো ও ফটোসেশান বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, যা হয়েছে এটা স্বাভাবিক, এতে আমি দোষের কিছু দেখি না।

বোয়ালমারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো আনোয়ার হোসেন বলেন, র‌্যাগ ডে এর নামে অশ্লীল কিছু উদযাপন নিষিদ্ধ, জর্জ একাডেমীর বিষয়টি আমি জানার সাথে সাথেই তা বন্ধ করতে নির্দেশনান দিয়েছি।

বার্তা বাজার/জে আই