জন্মনিবন্ধন সার্ভার বন্ধ থাকাসহ নানা জটিলতায় পাসপোর্ট ইস্যু ও নবায়ন করতে গিয়ে ভয়ানক বিড়ম্বনায় পড়ছেন দেশের অসংখ্য নাগরিক। তথ্য যাচাইয়ের সময় স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল সিস্টেমে আটকে যাচ্ছে আবেদন, ফলে সময় মতো পাসপোর্ট প্রিন্ট না হওয়ায় লক্ষাধীক সেবাগ্রহী ঠিক সময়ে হাতে পাচ্ছেন না কাঙ্খীত পাসপোর্ট। এদিকে অসংখ্য প্রবাসী শ্রমিকদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার উপক্রম হলেও জরুরী প্রয়োজনে কাঙ্খীত সেবা না পেয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন কেউ কেউ। এছাড়াও ব্যবসায়ীক, ভ্রমণ ও চিকিৎসাসহ জরুরি প্রয়োজনে দেশের বাইরে যেতে পারছেন না বিপুল সংখ্যক বহিঃর্গমন প্রত্যাশী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় দুই লাখ এমআরপি ও এবং লক্ষাধীক ই-পাসপোর্ট আবেদন আটকা পড়ে আছে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে। সেই সাথে ডেলিভারিতেও লেগে আছে বড় ধরনের জট। ভুক্তভোগীরা বলছেন, গত আগস্ট মাসের শুরুতে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সার্ভার হ্যাক করার হুমকি আসার পর, বিগত ১৪ আগস্ট রাত ১২টায় এনআইডি সার্ভার বন্ধ করে দেওয়া হয়। অতঃপর টানা ৩৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পরে ১৬ আগস্ট দুপুর ২টায় এনআইডি সার্ভারটি পুনরায় সচল করা হয়। এরপর থেকে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরসহ এনআইডির সার্ভার থেকে এ.পি.আইয়ের মাধ্যমে সহায়তা নেয়া প্রায় ১৭১টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রয়োজনে সেবা নিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছে। ফলে বিগত ১৬ আগস্টের পর থেকে পাসপোর্টের তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই করতে গেলে সফটওয়্যার কেন্দ্রিক জটিলতার ফাঁদ থেকে কোনোভাবেই নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না।

ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সফটওয়্যার বা সার্ভার জটিলতায়, আঁটকে পড়া আবেদনের হার গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ। এছাড়াও এমআরপি থেকে ই-পাসপোর্টে তথ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্র নিয়েও মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। নামের বানানসহ ছোটখাটো ভুলের কারণে আঁটকে যাচ্ছে অসংখ্য আবেদন। সেই সাথে পেমেন্ট গেটওয়েতে জমা দেওয়া টাকা ব্যাংকিং সার্ভার ডাউন দেখানোর ফলে অনেকে সময়মতো ছবি ও বায়োমেট্রিক দিতে পারছেন না। ফলে নতুন পাসপোর্ট ইস্যু ও নবায়নে দেখা দিয়েছে মারাত্মক বিড়ম্বনা।

সমাধানের উপায় প্রসঙ্গে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরিচালকের সঙ্গে আলাপ কালে, উল্ল্যেখ করার মতো তেমন কোন প্রতিউত্তর দিতে না পারলেও তার বক্তব্যে উঠে এসেছে সরকারী একাধিক প্রতিষ্ঠানের অসহযোগীতার চিত্র। বিশদ বর্ণনায় তিনি বলেন, নিবন্ধনের সার্ভার মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কারণে চলতি বছরের ১ আগস্ট থেকে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য অনলাইনে আবেদন বন্ধ রাখা হয়েছিল। ফলে পূর্বে যাদের আবেদন জন্মনিবন্ধন মারফত করা হয়েছিলো, তাদের ক্ষেত্রে সয়ংক্রিয় তথ্য যাচাই প্রক্রিয়াটি কাজ করছে না। বিষয়টি রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে একাধিকবার অবগত করার পরও মিলেনি যথাযথ সদুত্তোর। ফলে জন্মনিবন্ধন দিয়ে আবেদন করা সাধারণ জনগন দূর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. আবু নছর মোহম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘১ আগস্ট থেকে বেশ কিছু দিন আমাদের সার্ভার বন্ধ ছিল। মাঝখানে একবার চালু করার পর আবার কারিগরি জটিলতায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরক্ষনেই আমরা কয়েক দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুরক্ষিতভাবে সার্ভারটি পুনরায় চালু করেছি। বর্তমানে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনে সার্ভারসংক্রান্ত কোন জটিলতা অবশিষ্ট নেই।

এসব জটিলতার বাহিরে গিয়ে পাসপোর্ট ইস্যু ও নবায়নের জন্য জমা দেয়া টাকার বিষয় নিয়েও রয়েছে ভিন্ন মাতৃক বিড়ম্বনা। অনুমোদিত যে ছয়টি ব্যাংক ও বিকাশসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ জমা করা হচ্ছে, তা প্রায় সময়ই পেমেন্ট গেটওয়েতে আঁটকে থাকছে বলে জানান কতিপয় ভুক্তোভোগী। গেটওয়েজনিত জটিলতায় বিড়ম্বনার স্বীকার একজন আবেদনকারী জানান, তিনি পাসপোর্ট ফি’র টাকা জমা দিয়েছেন ঢাকা ব্যাংকে এবং তার স্ত্রী জমা দিয়েছেন বিকাশে। ছবি তোলা ও বায়োমেট্রেক দিতে গিয়ে দেখা যায়, বিকাশ পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে দেয়া পাসপোর্ট ফি ক্লিয়ার হয়নি। ফলে তাকে একাধিকবার পাসপোর্ট অফিসে যেতে হয়। একই সমস্যায় ভুক্তভোগী একাধীক আবেদনকারীরা জানান, সোনালী ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক সহ এমএফএস সার্ভিস নগদ, বিকাশের গেটওয়ে সার্ভারগুলোর জটিলতায় তাদেরকে ক্রমাগত বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। ফলে সময়মতো পাসপোর্ট ডেলিভারী পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

ইতিপূর্বে বিবৃত সব বিড়ম্বনা ছাপিয়ে যেটি ভয়ংকর ভাবে জায়গা করে নিয়েছে, সেটি হচ্ছে এমআরপি থেকে ই-পাসপোর্ট জটিলতা। বিশেষ করে সামান্য কিছু পরিবর্তন যেমন নামের অক্ষর বানান বয়স কিংবা ঠিকানা পরিবর্তন করতে গেলেই তা রীতিমত গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে যাচ্ছে। ফলে দালালের খপ্পর ছাড়া কোন ভাবেই মুক্ত হওয়া যাচ্ছে এসব উঁটকো বিড়ম্বনা থেকে। কারো কারো মতে পাসপোর্ট অফিসের কিছু অসাধু কর্তাদের যোগসাজোশে, আবেদন করার সময় অনিচ্ছাকৃত ভূল অথবা প্রকৃত সংশোধনীর জন্য করা আবেদনের বিপরীতে একটি সিন্ডিকেট অবৈধ অর্থ উপায়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। দালালদের হাতধরে মোটা অংকের বিনিময়ের মাধ্যমে মুহূর্তেই সংশোধিত হয়ে যাচ্ছে আবেদন। ফলে সুষ্ঠু সেবা প্রত্যাশীরা বঞ্চিত হচ্ছেন দিনের পর দিন। এসব দালালদের প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করা হলেও অজানা কারনে সপ্তাহের ব্যবধানে পুনরায় চালু হয় দালালের দৌরাত্ব। যা থেকে আশুমুক্তি চেয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন সাধারণ সেবা গ্রহীতারা।

এ প্রসঙ্গে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানু বলেন, ‘ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে সফটওয়্যারে আবেদন আটকে সাময়িকভাবে কিছু জটিলতা দেখা দিচ্ছে। আমরা আশা করছি, দ্রুতই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কোম্পানি এসব সমস্যার সমাধান করবে।’

ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরিচালক বলেন, ‘আমরা এখন খুব জরুরি না হলে এমআরপি দিচ্ছি না। আমরা পর্যায়ক্রমে সবাইকে ই-পাসপোর্টের আওতায় নিয়ে আসছি। বর্তমানে দৈনিক প্রায় ২৫ হাজার পাসপোর্ট প্রিন্ট দেওয়া হচ্ছে। আশাকরি অতি শীঘ্রই আবেদন এবং পরিসেবা প্রদান জট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে’

 

ই.এক্স/ও.আর/বার্তা বাজার