চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জ উপজেলার ধাইনগরে চৈতন্যপুর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার শিক্ষকদের অনিয়মের বিরুদ্ধে জবাবদীহি চাওয়ায় লাঞ্ছিত হয়েছেন মাদ্রাসার সভাপতি ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। শিক্ষকদের অপরাধ ঢাকতে শিক্ষার্থীদের দিয়ে লাঞ্ছিত করায় শিক্ষকরা বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, অভিযোগ পেয়ে আকস্মিকভাবে চৈতন্যপুর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসায় চলতি বছরের জুন মাসের ১৯ তারিখে পরিদর্শনে আসেন শিবগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ জয়নাল আবেদিন। পরিদর্শনে এসে সরকারের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে প্রতিষ্ঠানে পাঠ দান করছে এমন অনিয়ম দেখে প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ সকল শিক্ষককে ৩ কর্মদিবসের মধ্যে স্বশরীরে হাজির হয়ে লিখিতভাবে কারণ দর্শানোর নোটিশ করেন শিবগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা।

২০ জুন দেয়া নোটিশ প্রাপ্তির পর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ সকল শিক্ষকগণ লিখিত রেজুলেশনের মাধ্যমে দোষ স্বীকার করেন এবং অঙ্গীকার করেন যে আগামীতে তারা এমন অনিয়ম করবেন না বলে শিক্ষা কর্মকর্তার কারন দর্শানোর নোটিশের লিখিত জবাব দেন।

চলতি বছরের জুন মাসের ১৫ তারিখে অত্র প্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক (শরীরচর্চা) মোঃ জিয়াউর রহমান কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ছুটি ভোগ করেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মানবিক দিক বিবেচনা করে তার হাজিরা অনুপস্থিত না করে ক্যাজুয়াল লিফ(ঈখ) লিখে রাখেন। “চলতি বছরের জুন মাসের ১৮ তারিখে মাদ্রাসায় এসে প্রতিষ্ঠান প্রধান কে না বলে শিক্ষক হাজিরা খাতায় তার হাজিরা অনুপস্থিতের স্থলে ঈখ লিখা দেখে ফ্লুইড দিয়ে ঘোষা মাজা করে হাজিরা স্বাক্ষর করে এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে উগ্রো মেজাজে বলে আমি আমার হাজিরা স্বাক্ষর করেছি আপনি যা পারেন তা করেন।”

তাৎক্ষণিকভাবে চৈতন্যপুর সিনিয়র আলিম মাদ্রার গভনিং বডির সভাপতি আলহাজ্ব মোঃ আব্দুল কাদের মন্ডলকে লিখিত অভিযোগের মাধ্যমে বিষয়টি জানান। সভাপতি অভিযোগের বিষয়টি গভনিং বডির সভায় উপস্থাপন করেন এবং সর্বসম্মতি ক্রমে অনুমোদনের মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক মোঃ জিয়াউর রহমান কে (০৫) কার্যদিবসের মধ্যে জবাব চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেন। উল্লেখিত সময়ের মধ্যে লিখিত জবাবে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে দায়ী করে জবাব দেন সহকারী শিক্ষক মোঃ জিয়াউর রহমান।

অত্র মাদ্রাসার আরেকজন সহকারী শিক্ষক (গণিত) মোঃ সোহেল রানার বিরুদ্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত এবং গ্রুপিংসহ পাঠ দানে অনিয়মের অভিযোগে তাকে (৫) কার্যদিবসের মধ্যে লিখিত জবাব চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশ প্রাপ্তির পরে নিদৃষ্ট সময়ের মধ্যে সহকারী শিক্ষক মোঃ সোহেল রানা কারন দর্শানোর জবাব প্রদান করেন। ২৭ জুন/২৩ তারিখে মাদ্রাসার সভাপতি আলহাজ্ব মোঃ আব্দুল কাদের মন্ডল একটি জরুরী সভার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়রনরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করেন।

অভিভাবক সমাবেশে সভাপতি বলেন, চলতি বছরের জুন মাসে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্কা অত্র মাদ্রাসা পরিদর্শনে এসে অনিয়ম দেখে মাদ্রাসার সকল শিক্ষকগণকে শোকজ করেন এবং অত্র মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষিকা (ইংরেজি) সায়েদা প্রতিষ্ঠানে আসে ক্লাস নেয় অথচ হাজার খাতায় স্বাক্ষর করে না এমন অনিয়ম দেখে তাকেও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শোকজ করেন। এটা আমাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য দুঃখ জনক। আরো একটি বিষয় হলো, আমি সভাপতি নিজে মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠানের নামে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোবরাতলা ইউনিয়ন এলাকায় ৫ কাঠা জমি দান করেছি, সে জমিটা তৎকালীন সভাপতি মোঃ নজরুল ইসলাম অসৎ উদ্দেশ্যে বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎ করেছে।

আয়োজিত অভিভাবক সমাবেশে সকল শিক্ষকদের উদ্দেশ্য তিনি আরো বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সরকারের দেয়া নিয়মনিতি মেনে চলার আহবান জানান এবং শিক্ষার্থীদের অভিভাবকগণ কে তাদের ছেলে মেয়ের লেখা পড়ার বিষয়ে খোজ খবর রাখার জন্য অনুরোধ করেন সভাপতি। ৩০ শে জুন তারিখে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সাদিকুল ইসলাম দাপ্তরিক কাজে শিক্ষা অফিস ও আদালতে থাকার সুবাদে সহকারী শিক্ষক মোঃ সোহেল রানা ও মোঃ জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতির বিরুদ্ধে কিছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলন করার কূটকৌশল করে এবং পরদিন ৩১ জুন তারিখে ব্যানার হাতে নিয়ে চৈতন্যপুর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসা প্রঙ্গনে আন্দোলন করে।

এমন বিশৃঙ্খলা আচরন দেখে প্রতিষ্ঠান প্রধান উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও গভনিং বডির সভাপতি কে বিষয়টি জানালে ২ আগস্ট তারিখে সরজমিন পরিদর্শনে আসেন শিবগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সভাপতি আলহাজ্ব মোঃ আব্দুল কাদের মন্ডল। শিক্ষা কর্মকর্তা ও সভাপতি কে মাদ্রাসায় আসার অল্প সময়ের মধ্যে পূণরায় সহকারী শিক্ষক জিয়াউর রহমান ও সোহেল রানাসহ কিছু শিক্ষার্থীকে দিয়ে আন্দোলন শুরু করে এবং সভাপতি ও শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করে। এমন পরিস্থিতি দেখে সভাপতি ও শিক্ষা কর্মকর্তা শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানালে তাৎক্ষণিক থানা পুলিশ ঘটনা স্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং তাদের সহায়তায় শিক্ষা কর্মকর্তা ও সভাপতি বাড়ী পৌছান।

এব্যাপারে চৈতন্যপুর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মোঃ জিয়াউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি আমার হাজিরা খাতায় ঈ.খ লিখা দেখে সেটা কাটিয়ে আমার হাজিরা স্বাক্ষর করেছি। আরেক সহকারী শিক্ষক মোঃ সোহেল রানার সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

অত্র প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা মোঃ সাদিকুল ইসলামের কাছে মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, এটা শুধু আমার নয়, প্রতিষ্ঠানেরও সম্মানের হানি করেছে সহকারী শিক্ষক মোঃ জিয়াউর রহমান ও মোঃ সোহেল রানা।

শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) চৌধুরী জোবায়ের আহাম্মদ জানান, চৈতন্যপুর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সংবাদ পাওয়া মাত্র পুলিশ সদস্যদের ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় এবং উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও মাদ্রাসার সভাপতি কে নিরাপদ স্থানে পৌছে দেয়া হয়।

মাদ্রাসার সভাপতি আলহাজ্ব মোঃ আব্দুল কাদের মন্ডলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমি মাদ্রাসার সভাপতি, প্রতিষ্ঠানে সুনামের সহিত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। কিন্তু প্রায় ২ মাস থেকে দুইজন সহকারী শিক্ষক মোঃ জিয়াউর রহমান ও মোঃ সোহেল রানা একজোট হয়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে উঠেছে এবং কিছু শিক্ষার্থীদেরকে ভুল বুঝিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে রুপান্তরিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সভাপতি আরও বলেন, উক্ত ঘটনার দিন মাদ্রাসা থেকে পুলিশের সহায়তায় বাসায় এসেছি এবং বর্তমানে দুর্নীতিবাজ শিক্ষকদের এমন আচরণ ও কূটকৌশলে আমি ভীষণ নিরাপত্তা হীনতায় রয়েছি।

এ বিষয়ে শিবগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ জয়নাল আবেদীন জানান, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক ও কষ্টদায়ক। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার জবাবদীহি চাওয়ায় প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষক বিরুদ্ধাচরক করে শিক্ষার্থীদের দিয়ে সভাপতিসহ আমাকে লাঞ্ছিত করে। পরে পুলিশ এসে নিয়ন্ত্রণ না করলে সভাপতি এবং আমার অবস্থা কি হতো বলা যেতো না। পুলিশের সহায়তায় সভাপতি এবং আমি সেখানে থেকে কোনভাবে এসেছি।

বার্তাবাজার/এম আই