সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের শুরু থেকেই ব্যাংক থেকে বেশি হারে ঋণ নিচ্ছিল সরকার। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নগদ টাকার সংকটে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংককেই জোগান দিতে হয়েছে এই ঋণ। প্রথম দিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আগের নেওয়া ঋণ ফেরত দিয়েছে সরকার। তবে অর্থবছরের শেষ দিকে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারকে ঋণের জোগান দিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকও। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া সর্বশেষ হিসাব বলছে, গত ২২ জুন পর্যন্ত সরকারের নেওয়া নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা। ৩০ জুন পর্যন্ত হিসাব হালনাগাদ হলে ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের মোট ঋণের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা।

বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা। তবে পরে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই এর চেয়ে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার।

অন্যদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। যদিও অর্থবছরের ১০ মাসে রাজস্ব আহরণ হয়েছে মাত্র ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরের গত ২২ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৯ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। আর একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ১০ হাজার ১০২ কোটি টাকা। আগের বছর এই খাত থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ৫৫ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। বাকি ৩০ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা নিয়েছিল বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র জাকির হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘সরকার ঋণ চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংককে তা অবশ্যই দিতে হবে। তবে প্রতিবছর সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে থাকে। কখনো তা বাড়তে পারে, আবার কখনো তা কমতে পারে। সরকার প্রয়োজনে নিয়েছে, আবার যথাসময়ে তা সমন্বয়ও হয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে বাজার থেকে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। এখন যদি ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে বাজার থেকে আরও টাকা তুলে নেওয়া হয় তাহলে বাজারে তারল্য সংকট তৈরি হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল কাজই হচ্ছে, প্রয়োজন অনুযায়ী মুদ্রা সরবরাহ ঠিক রাখা। মুদ্রানীতি কার্যকর করতে কখনো কখনো বাজারে টাকা ছাড়তে হয়। আবার প্রয়োজন অনুযায় কখনো বাজার থেকে টাকা তুলে নিতে হয়। বর্তমানে বিশেষ পরিস্থিতিতে বাজারে টাকার সরবরাহ বিবেচনা করেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ট্রেজারি বিল-বন্ড নিজেই কিনে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তা আবার বাজারে ছেড়ে দেওয়া হবে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনী বছরের আগে বিভিন্ন উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে সরকার এখন ব্যাংক থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নিচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ঋণের উৎস হিসেবে আগে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নিলেও বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণেই ঝুঁকছে সরকার। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় সরকারকে ব্যাংকমুখী না হয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সরকার বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে আগে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নিত। এই দুটো খাতে সরকারের সুদ পরিশোধে ব্যয় বেশি বলে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনেক বেশি পরিমাণে ঋণ নিচ্ছে। সেটা আরও বেশি ভয়াবহ। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি রয়েছে। এই অবস্থায় সরকারকে রাজস্ব আদায়ে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে।’