সরকারের পক্ষ থেকে মূল্য বেঁধে দেয়া হলেও কোরবানি পশুর চামড়ার দাম নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। গত কয়েক বছরের মতো এবারও একই খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছে। লাভের আশায় চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা।

 

রাজধানীতে ২৫ থেকে ৩০ ফুট আকারের একেকটি বড় গরুর চামড়া মাত্র ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ নিয়ে চামড়া সংগ্রহকারী মৌসুমী ব্যবসায়ী, ফড়িয়া এবং বিভিন্ন মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, যে দাম হওয়ার কথা তার অর্ধেক মূল্যে বেচে দিতে হয়েছে চামড়া। বলা যায়, সিন্ডিকেটের হাতেই ছিল চামড়ার বাজারের নিয়ন্ত্রণ। এদিকে বৃষ্টির মধ্যে চামড়া কেনাবেচা নিয়ে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে তাদের।

 

কয়েকজন মৌসুমী ব্যবসায়ী জানান, যে দামে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে তাতে করে লাভ তো দূরের কথা, কেনা দাম উঠছে না। তা ছাড়া গরুর চামড়া বিক্রি করা গেলেও ছাগলের চামড়া কেউ নিচ্ছে না। তবে কেউ কেউ গতবারের চেয়ে দাম বেশি পেয়েছেন জানা গেছে। তবে ন্যায্য দামেই চামড়া কেনা হচ্ছে জানিয়ে লবণের দাম বাড়ার কারণে বাড়তি দাম দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি চামড়া ক্রেতাদের।

 

উল্লেখ্য, আগের বছরগুলোতেও কোরবানির পশুর চামড়ার দাম বেঁধে দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা মানা হয়নি। কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে কিনে নেয়া হয়েছে পশুর চামড়া। এবার চামড়ার বেঁধে দেয়া দাম কিছুটা বাড়ানো হলেও তার সুফল বিক্রেতা পর্যায়ে পৌঁছেনি।

 

ঈদের দিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই শুরু হয় বৃষ্টি। এর মধ্যেই রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে আনা হয় কোরবানি পশুর চামড়া। কিন্তু সংগ্রহকারী সংশ্লিষ্টরা ন্যায্যমূল্য পাননি। তাদের সবার মধ্যেই দাম নিয়ে ছিল ক্ষোভ। এখানে বড় আকারের কাঁচা চামড়ার বিক্রি মূল্য ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে। আর মাঝারি গরুর চামড়া ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং ছোট আকারের চামড়ার দাম দেয়া হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।

 

রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে মৌসুমী ব্যবসায়ী সাধন চন্দ্র দাস বলেন, ৭০০ টাকা করে প্রতি পিস চামড়া কিনে নিয়ে এসে এখানে এসে দেখি, দাম দেয়া হচ্ছে ৬০০ টাকা। আরেক মৌসুমী ব্যবসায়ী মুকুল বলেন, বড় বড় চামড়া ৮০০ টাকার বেশি বলা হচ্ছে না। সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে দেয়া হয়েছে।

 

ঈদের আগে সরকার রাজধানীতে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। কোনো গরুর চামড়া ২৫ বর্গফুট হলেও সরকার নির্ধারিত দামে তা হওয়ার কথা অন্তত ১২৫০ টাকা। কিন্তু কোনো চামড়ার দামই হাজার টাকা বলতে দেখা যায়নি আড়তদারদের। বরং ইচ্ছেমতো দামে বেচাকেনা হয় চামড়া। আর ছাগলের চামড়ার ক্রেতা ছিল না বললেই চলে। যদিও নেয়া হয়, প্রতি পিসে এক কাপ চায়ের দামও দেয়া হয়নি। ধরা হয় ৫ থেকে ১০ টাকা।

 

রাজধানীর সবচেয়ে পুরনো চামড়ার আড়ত লালবাগের পোস্তাতেও পরিস্থিতির ভিন্নতা ছিল না। অভিযোগ আছে, সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করেনি কোনো আড়তদার। তারা বলেছেন, চামড়া প্রক্রিয়াকরণে প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেশি, তাই বেশি দামে চামড়া কেনা যাচ্ছে না।

 

সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীতে সংগ্রহ করা হয় পশুর চামড়া। মাদরাসা ও এতিমখানার চামড়াই এখানে বেশি আসে। দামের ক্ষেত্রে সেই মাদরাসা-এতিমখানা কর্তৃপক্ষেরও ছিল হতাশা।

 

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়শনের দাবি, কাঁচা চামড়া নিয়ে অভিযোগ থাকলেও লবণ দেয়া চামড়া কেনা-বেচা হবে সরকার বেঁধে দেয়া দামেই। বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ায় এ বছর ৫ থেকে ১০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। আর কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আফতাব খান বলেন, পোস্তায় চামড়া কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। বেঁধে দেয়া দামেই বেচা-কেনা হচ্ছে চামড়া।

 

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, মৌসুমী ব্যবসায়ীরা খুচরা পর্যায়ে বিক্ষিপ্তভাবে কেনা-বেচা করছে। এতে পুরো বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, মাদ্রাসা ও এতিমখানা থেকে যারা বিক্রি করছেন, তারা ন্যায্য দামই পাচ্ছেন।

 

এদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কোরবানি উপলক্ষে এ বছর সারা দেশে ৯৪ লাখ ৪৩ হাজারের বেশি পশু বিক্রি হয়েছে। এরমধ্যে ৪৩ লাখ ৬১ হাজার গরু-মহিষ ও ৫০ লাখ ৮১ হাজার ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য পশু বিক্রি হয়েছে। বিক্রিত পশুর দাম ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ বছর দেশের আট বিভাগেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কোরবানির পশু বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়। অনলাইনে মোট পশু বিক্রি হয়েছে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৯৬টি। এরমধ্যে সব চেয়ে বেশি গরু বিক্রি হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এর পরিমাণ ৮৪ হাজার। এছাড়া ঢাকায় ছাগল-ভেড়া বিক্রি হয়েছে বেশি। এর পরিমাণ ২১ হাজার ৯০২টি।

 

রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানার চামড়ার মৌসুমী ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়া বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারও কিছুটা লাভের আশায় পাড়া মহল্লায় কোরবানির পশুর চামড়া কিনেছি। স্থানীয়দের কাছ থেকে গরুর চামড়া কিনেছি ৩৫০ টাকা করে। কিন্তু চামড়া বিক্রি করতে এসে শুনি দাম বলছে ৩৩০ টাকা। এখন বাধ্য হয়ে তাদের দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। এগুলো রাখা তো সম্ভব নয়। আর খাসির চামড়া তো নিতেই চাচ্ছে না। ১৩টি খাসির চামড়া নিয়ে এসেছিলাম। সবগুলো চামড়া মাত্র ৫০ টাকায় দিয়েছে। সরকার যে চামড়ার দাম বেঁধে দিয়েছে সেই দামে এখানে চামড়া কিনছে না।

 

চামড়া ক্রেতা জব্বার আলী বলেন, এবার আমরা তো বাড়তি দাম দিয়েই চামড়া কিনেছি। লবণের বাড়তি দামের কারণে চামড়া প্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা খরচ পড়ে যাবে। সরকার যে হিসাবে চামড়ার দামের ঘোষণা দিয়েছে সেই হিসাবে যদি এখন ট্যানারি মালিকরা আমাদের কাছ থেকে চামড়া কিনে তাহলে কিছুটা লাভ হবে। আর যদি না কিনে তাহলে ব্যবসায়ীদের বড় লোকসান হবে।

 

 

ই.এক্স/ও.আর/বার্তা বাজার