নারায়ণগঞ্জের প্রাণ শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীর তীরে আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে দখলদাররা। করোনাকালীন সময়ে নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান কম হওয়ার দরুন বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ইটভাটার মালিকরা নদী দখলের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল। প্রতি বছরই ইটভাটার মালিকরা তাদের নষ্ট ইট ও মাটি ফেলে ধলেশ্বরী নদী ভরাট ও দখল করে চলেছে।

তেমনিভাবে শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীরেই বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বালু ফেলে নদী ভরাট ও দখলে লিপ্ত হয়ে উঠেছে। বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিনিয়ত দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও বেশ কিছু স্থানে নদীর জায়গা ভরাট ও দখলের পায়তারা চলছে বলে অভিযোগে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৯ সালের জুন মাসে হাইকোর্ট রীট পিটিশন নং ৩৫০৩/২০০৯ এর নির্দেশনা অনুযায়ী শীতলক্ষ্যা নদীসহ রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী ৪টি নদী রক্ষায় জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএকে নির্দেশ দেয়। আর এ নির্দেশনার পরেই ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে শীতলক্ষ্যা। এরপর নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের যৌথ উদ্যোগে শীতলক্ষ্যা নদীর কয়েক হাজার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে।

কাঁচপুর সেতুর দুই পাশে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে ৫ কিলোমিটার এলাকায় নদীর তীর রক্ষায় পাকা স্থাপনা নির্মাণ, ওয়াকওয়ে (হাটার চলার জন্য) নির্মাণ ও গাছ লাগানোর জন্য ১৭ কোটি টাকার নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১২ সালের জুন মাসে। শেষ হয় ২০১৪ সালের জুনে। ওয়াকওয়ের সঙ্গে নদীর তীররক্ষা বাঁধও নির্মাণ করা হয়।

ওয়াকওয়েটি মূলত ঢাকার ডেমরা থানার করিম জুট মিলস এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সাইলো (সিদ্ধিরগঞ্জ বাজার) এলাকা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের ৫নং খেয়াঘাট থেকে নিতাইগঞ্জ খালঘাট পর্যন্ত প্রায় পৌনে তিন কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমিতে হাইকোর্টের নির্দেশে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) পদ্ধতিতে সিএস জরিপ মোতাবেক সীমানা পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষাঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (২য় পর্যায়) (১ম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পটির মোট ব্যায় ১ হাজার ১৮১ কোটি ১০ লাখ ৩১ হাজার টাকা। প্রকল্পটির নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যায় ১৭ কিলোমিটারের নির্মাণ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা।

শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে প্রিমিয়ার সিমেন্ট থেকে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার, সুলতানা কামাল ব্রীজ এলাকায় ৩ কিলোমিটার এবং শীতলক্ষ্যার পূর্ব তীরে বন্দরে ডিআইপিটিসি থেকে আকিজ সিমেন্ট পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ওয়াকওয়ে নির্মিত হবে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ নারায়ণগঞ্জেও চলমান রয়েছে। শীতলক্ষ্যা তীরে সীমানা পিলার স্থাপন কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।

২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারীতে নদীকে জীবন্ত সত্বা ঘোষণা করে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এর পরপরই জোরেশোরে শুরু হয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ’র উচ্ছেদ অভিযান। বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে ২০২১ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত বছরে শীতলক্ষ্যা নদীতে ২ হাজার ৪৭৫টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল।

যার মধ্যে সর্বমোট উচ্ছেদকৃত তীরভূমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১০৫ একর। জব্দকৃত মালামাল সর্বমোট নিলাম দেয়া হয়েছিল ২ কোটি ৫৫ লাখ ২২ হাজার ৬০০ টাকা। সর্বমোট জরিমানা আদায় করা হয়েছিল ৩১ লাখ ৩১ হাজার টাকা।

এদিকে সীমানা পিলার এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ চলমান থাকলেও ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ বন্ধ ছিল উচ্ছেদ অভিযান। বিআইডব্লিউটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট না থাকা এবং উচ্ছেদের অন্যতম হাতিয়ার ভেকুর সঙ্কট থাকায় প্রায় দেড় বছর ধরেই বন্ধ ছিল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। এতে শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীর উভয় তীরেই বেশ কিছু স্থানে অবৈধ দখলদাররা আবারো তৎপর হয়ে উঠেছিল।

২০২৩ সালের শুরুতে অভিযান শুরু হলেও দখলদারদের বেপরোয়া মনোভাব কমেনি। গতবছরের ২৩ ডিসেম্বরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বগ্রাম, ইরিনা ও তারাবো মৌজা এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে পূর্বগ্রাম মৌজায় খান ডকইয়ার্ডের মালিকের নদী ভরাটকৃত অংশ উচ্ছেদ করা হলেও সেখানে আবারো নদী ভরাট ও দখল পায়তারা শুরু হয়েছে।

ধলেশ্বরী নদীতে গেল বছরে ইটভাটা মালিকদের নদী দখল করে নির্মিত গাইড ওয়াল ও বাশের পাইলিং উচ্ছেদ করেছিল বিআইডব্লিউটিএ। তবে বছর না গড়াতেই সেখানে আবারো পরিবেশ দূষণকারী ইটভাটার মালিকরা গাইডওয়াল ও বাশের পাইলিং এর মাধ্যমে নদী দখল ও ভরাট কার্যক্রম চালাচ্ছে। সচেতন মহল বলছে, অবৈধ স্থাপনার মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা অথবা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হলে দখল ও ভরাট কার্যক্রম বন্ধ হতে পারে।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বার্তা বাজারকে জানান, আমরা গেল বছরে বেশ কয়েক শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছি। ইতোমধ্যে অবৈধ দখলদারদের একটি তালিকা প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করেছি। নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দখলদাররা যতই শক্তিশালী হোকনা কেন তাদের কোন ছাড় নেই।

বার্তাবাজার/এম আই