দক্ষিণ এশিয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলগুলোর মধ্যে গণমাধ্যমের তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষন এবং সরবরাহ করার ধরন ও সেই সাথে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিক্রিয়া গ্রহনের যে তাৎক্ষনিক ব্যাবস্থাপনা তা একটি নতুন প্রজন্মের মধ্য দিয়ে আবহমান। আমরা যদি বিগত কয়েক দশকের জাতীয় এবং রাজনীতির পাশাপাশি বিনোদন মাধ্যমগুলোর দিকে তাকাই, তবে আমরা যা দেখতে পাবো তা হচ্ছে- প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে সংবাদ এবং জনগনের মধ্যে কেবলমাত্র একটি সময়ের পার্থক্য তৈরী হয়েছে যা হয়তো অতীতে ২৪ ঘন্টা বা তারচেয়েও বেশী ব্যাপ্তির হলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে কয়েক সেকেন্ড এর ব্যাবধানে।
এখন আলোচনা এমন হতে পারে যে, সংবাদ এবং জনগনের মধ্যকার দূরত্ব যদি এতোটাই সংকীর্ণ হয়ে থাকে তবে উৎকর্ষের পর্যালোচনায় তার ব্যবহারিক পরিচর্যার এত অভাব কিভাবে সৃষ্ঠি হলো? অথবা প্রশ্নটা এভাবেও দাঁড়াতে পারে যে, আদৌ কি আমরা গণমাধ্যমে প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং তার প্রয়োগিক সহজিকরনের যথাযথ সেবা পাচ্ছি? আমার মনে হয় না। পাচ্ছি না। কারণ, আমি প্রথমেই বলতে চাই বিগত এক শতাব্দীতে যা যা পরিবর্তন হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন দৃশ্যত হয়েছে ভাষার ব্যকরণে। তারপর ভূখণ্ডে। তারপর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। এখন এই প্রত্যেকটা পরিবর্তন কিন্তু প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমকে তার স্বীয় স্বত্তায় প্রভাবিত করেছে। যা হয়তো অন্যন্য উপমহাদেশীয় গণমাধ্যমগুলোতে এতোটা প্রভাবিত হওয়ার মতো নৈতিক কিংবা পৈচাশিক স্বাধীনতা পায় নি।
কেন আমি নৈতিক বললাম তার একটা বিশদ ব্যখ্যা রয়েছে। এই আলোচনায় প্রবেশ করতে গেলে আমাকে প্রথমেই যে বিষয়গুলো তুলে আনতে হবে তা হচ্ছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম। এখন আমি যদি বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমকে বিবেচনা করতে চাই তবে বলতেই হয়, আমরা প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত হয়েছি ঠিকই, সেই অনুপাতে আমাদের মধ্যে সাংবাদিকতা কিংবা সম্পাদনা যথানুপাতিক মানের উন্নয়ন হয়নি।
আমাদের মধ্যে যে সকল বিষয়গুলো সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে প্রকট হয় তার মধ্যে নৈতিকতা বহির্ভূত ভাবে ব্যাক্তি স্বার্থ কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থের প্রভাবিকরণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। এখন প্রভাবিকরণের কিন্তু আবার স্তরভেদে পার্থক্য রয়েছে। স্বার্থ ও অংকভেদে প্রভাবক এবং ধ্রুবকের যে গতিবিধি তা যথাযথভাবে তুলে না আনলে, পাঠক হয়তো বিভ্রান্তির মধ্যে থাকবেন আমি মুলত কোন বিষয়কে এখানে মূখ্য বলে বিবেচনা করেছি।
এখন আপনি জানেন যে, প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন এবং প্রজ্ঞাপনের বাজারে, বিজ্ঞপ্তি গ্রহীতা কিংবা পাঠকের অনুপাত প্রয়োগিক ক্ষেত্র অত্যান্ত ক্ষীণ। তার মানে হচ্ছে, যে পরিমান অর্থ আমরা জাতীয়, রাজনীতি এবং বিনোদন বিভাগ কেবলমাত্র বিজ্ঞাপন বাবদ পেয়ে থাকি, তা হয়তো বিশ্বের অনেক উন্নত দেশও পায় না। আমাদের দেশে এখনো যথাযথ টি.আর.পি রেশিওর উপর বিবেচনা করে গণমাধ্যমিক কিংবা বিজ্ঞাপনী ব্যয় ধার্য্য করা হয় না। যার প্রেক্ষিতে হয়তো এখন কিঞ্চিত সময়ের জন্য আমাদের শিল্পের মুষ্ঠিমেয় লোক অতীব মুনাফা লাভ করছে। তবে এর যে বাজে প্রভাব ভবিষ্যতে পড়তে যাচ্ছে, তা দীর্ঘকালীন প্রতিক্রিয়া ফেলবে নিঃসন্দেহে। যা হয়তো এখনো আমাদের দূরদর্শিতার বাইরে।
আমাদের গণমাধ্যমের সমালোচনার এক পর্যায়ে আমি ইতোপূর্বে এমন অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, যা হয়তো অনেকাংশেই আমাদের মুষ্ঠিমেয় বিশেষজ্ঞগণের চক্ষুশূল হবার উপক্রমে অবতীর্ন হয়েছিলো। অতঃপর পরিবেশ এবং পরিস্থিতি রক্ষায় আমাকে বক্তব্য বন্ধ করতে হয়েছে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, একজন সম্পাদককে যদি পরিস্থিতির বিবেচনায় বাকস্বাধীনতা থাকার পরেও চুপ করে যেতে হয়, সেখানে একজন সাধারণ প্রতিবেদক কতোটা স্বাধীন? প্রতিবেদক তো অনেক মূখ্য, আমরা বরং গণমতের ব্যাপারেই প্রশ্নটা রাখলাম। একজন সাধারণ নাগরিক যদি একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী কিংবা রাজনৈতিকের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে যৌক্তিক সমালোচনা করে, সেই সাধারণ মুখের সবচেয়ে অ-গুরত্বপূর্ণ সমালোচনা কি আমরা আদৌ সঠিকভাবে হজম করতে পারি? আমরা সেটা পারি না। আমি অন্তত আমার প্রায় এক দশকের জাতীয় রাজনীতিতে সেটা কাউকেই পারতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
এবার না হয় কিছুটা প্রযুক্তিগত বিষয়ে আমাদের গণমাধ্যমের দূর্বলতা নিয়ে আলোচনা করি। প্রথমত, ডিভাইস ফ্রেন্ডলী জার্নালিজম বলতে যা বুঝায়, তা এখনো আমরা আয়ত্ব করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে এখনও এমন প্রতিবেদক রয়েছেন যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর গণমাধ্যমিক ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। এমনকি আধুনিক প্রতিবেদন তৈরির জন্য যে প্রশিক্ষন প্রয়োজন, সেটারও কোন উদ্যোগ আমাদের গণমাধ্যমের উপরের মহলের নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে মালিকপক্ষ কারোর মধ্যেই দেখা যাচ্ছে না। যেখানে আমাদের প্বার্শবর্তী দেশ একেকটা প্রতিবেদককে এককেটি স্ট্রিমিং চ্যানেলে উন্নীত করে যাচ্ছেন, সেখানে আমরা এখনও এই পার্থক্য করতে ব্যস্ত যে, এতে করে সম্প্রচার সংক্রান্ত পূর্নস্বত্ত্ব কিংবা নিয়ন্ত্রন আদৌ হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে কি না।
এক্ষেত্রে আমি আবারও সতর্কতার জানান দিয়ে বলতে চাই। আমরা যেকোনো মুহুর্তে একটা প্রবল তথ্য প্রবাহের অব্যবস্থাপনার মধ্যে আছড়ে পড়তে যাচ্ছি। যা হয়তো গণমাধ্যমিক বাস্তবতায় এর সুফল কিঞ্চিত জনগনের পক্ষে গেলেও এর একটি দীর্ঘ মেয়াদী কুপ্রভাব শীঘ্রই পড়তে যাচ্ছে। যা এখনই নীতিমালার আওতায় এনে পরিবর্তন করতে সক্ষম না হলে, ভবিষ্যতে এর মূল উৎপাটন করে শুদ্ধি করা অসম্ভব হবে তাতে খুব একটা সন্দেহ থাকে না।
এবার আসা যাক ব্যক্তিস্বার্থের পর্বে। একটি গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ মুল স্তম্ভ হিসেবে মুল্যায়ন করা হয়। তার মানে আইন, শাষন, বিচারব্যবস্থার পরেই এর অবস্থান। একজন জনগন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কি কি সুবিধা ও সেবা পেতে পারে তার ব্যাপারে অবশ্যই একটি গণমাধ্যমকে কাজ করতে হয়। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় গণমাধ্যমের আসলে কার জন্য কাজ করা উচিত এবং সে কার জন্য বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। একজন সাধারণ নির্যাতিতার পক্ষে একটি গণমাধ্যম যতটা শক্তিশালী হিসেবে কাজ করে, একইভাবে একটি সমাজের অব্যবস্থাপনার জন্য একটি মাধ্যম সঠিক অওয়াজ তুলতে পারে কি না তা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যায়। আমরা যেভাবে গণমাধ্যমের শক্তিকে অপব্যবহারে ব্যস্ত রেখেছি কিংবা চাটুকারিতায় ব্যস্ত রেখেছি, সেটা কি আদৌ সাংবাদিকতার পন্থিতার উপর সঠিক বিচার করতে সক্ষম হয়েছে বলে ধারনা করতে পারি? মনে হয় না। সেই ধারনা থেকে আমরা এখনো দীর্ঘ পথের দূরুত্বে অবস্থান করছি।
এ থেকে পরিত্রানের উপায় কি হতে পারে সে আলোচনা অনেক বিশদ। তাই আপাতত কোন রকম দীর্ঘ মেয়াদী সংলাপে না গিয়ে বরং একটি পরিসংস্থানে আসতে পারি যে, আমরা চাইলেই যেমন বর্তমান প্রযুক্তির সহায়তায় সংবাদ ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞা বদলে দিতে পারি ঠিক তেমনই ভাবে আমরা চাইলে এর অব্যবস্থাপনায় একটি ঝুঁকিপূর্ন গণমাধ্যমিক জঞ্জালে পরিনত হতে পারি। সিদ্ধান্ত একান্তই আমাদের। আমরা কি চাই এবং কোনটা করতে চাই, অথবা আমাদের কি করা উচিত। আশা করি আমার বক্তব্য কিছুটা হলেও বর্তমান চিত্রের উপর আলোকপাত করতে সক্ষম হয়েছে। যা একজন প্রতিবেদককেই নয় বরং একজন পাঠককেও দ্বিতীয়বার নিজ দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে দ্বায়িত্ববান করবে।