আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ও আইএনজিও গুলোর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদে কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোয় প্রায়ই গোলাগুলি, সংঘর্ষ ও খুনোখুনির ঘটনা ঘটেই চলছে। পাশাপাশি ক্যাম্পের আধিপত্য বিস্তার, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ এবং চাঁদাবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে অধিপত্যে বিস্তারের এই লড়াইয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত। এছাড়াও জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আশ্রয়শিবিরে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বৃহস্পতিবার একই দিনে খুন হয়েছে ৩ জন।

সবশেষ ২১ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) ভোররাত ৪ টা ও ৬ টা এবং বিকেল ৩টায় উপজেলার ১৭ নম্বর ক্যাম্পে সি ব্লক ও কুতুপালং ৪ নং এবং জামতলী ১৫ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জামতলী ব্লক-ডি/৭ এ তিন হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মো শামীম হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার ভোর রাতে একদল দুষ্কৃতকারী ৪ নম্বর মধুরছড়া ক্যাম্পের এফ ব্লকের হেড মাঝি নাদির হোসেনকে ঘর থেকে ডেকে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে উপুর্যুপরি ছুরিকাঘাত ও গুলি করে। এতে ঘটনাস্হলেই মারা যায় তিনি। নাদির হোসেন ক্যাম্পের এফ ব্লকের হেড মাঝি (কমিউনিটি লিডার) ও মৃত সৈয়দ আহমেদের পুত্র।

পরে একই দিন ভোরে ১৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সি ব্লকে ৭/৮ জনের একদল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ আমিনের পুত্র আব্দুল্লাহকে ঘর থেকে অস্ত্রের মুখে বের করে পাশে বাজারের রাস্তায় নিয়ে আসে। সন্ত্রাসীরা এক পর্যায়ে আব্দুল্লাহকে রাস্তায় ফেলে বুকে এক পর্যায়ে উপুর্যুপরি গুলি করে।

অপরদিকে বিকেল ৩টার দিকে পালংখালীর জামতলী ১৫ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি/৭ ব্লকে আরসা ও আরএসও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। একপর্যায়ে আরএসও সদস্য ওই ক্যাম্পের আবু সিদ্দিকের ছেলে ওমর মিয়া প্রকাশ মাষ্টার আইয়ুব (৩৫) কে আরসা সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি দা দিয়ে মুখমন্ডলে কুপিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়।

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত পাঁচ মাসে আশ্রয়শিবিরগুলোয় একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৪০ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জন রোহিঙ্গা (মাঝি) নেতা, ১০ জন সন্ত্রাসী গ্রুপ আরসা, ১ জন স্বেচ্ছাসেবক ও অন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা।

ক্যাম্প সংশ্লিষ্ট এলাকা পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, ক্যাম্পের পরিবেশ অস্থিতিশীল রেখে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আন্তর্জাতিক চক্রান্তে অনেক আইএনজিও এসব সহিংস ঘটনার পেছনে প্রত্যেক এবং পরোক্ষ ভাবে মদদ দিচ্ছে। এতে তাদের দিচ্ছে মোটা অংকের অর্থ সহায়তা। গোয়েন্দা সংস্থা গুলোর মাধ্যমে তথ্য নিয়ে সরকার এদের বিরুদ্ধে তড়িৎ ব্যবস্থা না নিলে সামনে আরো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের উখিয়ার সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিকদার এ প্রসঙ্গে বলেন, আন্তর্জাতিক চক্রগুলো দেশের পরিস্থিতি কে অশান্ত করতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোকে টার্গেট করে রোহিঙ্গাদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করছে যার কারণে বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রতিনিয়ত অস্ত্রের ঝনঝনানী এবং প্রাণহানীর ঘটনা ঘটছে। ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠী চরম আতঙ্ক ও ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মো শামীম হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ক্যাম্পে আধিপত্য ও নানা অপকর্ম নিয়ন্ত্রণে সন্ত্রাসী গ্রুপ গুলোর মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এছাড়াও অনেক আন্তর্জাতিক ও দেশি এনজিওর কার্যক্রম সন্দেহজনক, তাদের গতিবিধি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যবেক্ষণে রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত এপ্রিল মাসে উখিয়ার কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে পাঁচটি পৃথক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় দুজন আরসা সন্ত্রাসীসহ পাঁচজন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধ হয় এক রোহিঙ্গা। গত মার্চ মাসে কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে ১০টি পৃথক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ১১ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হয় এক শিশুসহ চার রোহিঙ্গা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক রোহিঙ্গা নেতা জানান, সন্ধ্যা নামার পরপরই আশ্রয়শিবিরগুলোয় আরসা, আরএসও সহ একাধিক গোষ্ঠী অস্ত্রের মহড়া দেয়। আধিপত্য বিস্তারে সন্ত্রাসীরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।

উখিয়ার কুতুপালং, মধুরছড়া, লম্বাশিয়া, বালুখালীসহ বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে আরসার প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনিসহ আটজন সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। বার্মিজ ও ইংরেজি ভাষায় লেখা পোস্টারে আরসা সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিলে লাখ টাকার পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়।

এর আগে মাদক চোরাচালানের অন্যতম হোতা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনকে ধরিয়ে দিতে পোস্টার লাগানো হয়েছিল। গত বছরের মার্চে নবী হোসেনকে ধরিয়ে দিলে ১০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে পোস্টার সেঁটেছিল কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি।

গত চলতি বছরে ১৪ এপিবিএন উখিয়ার বালুখালীসহ কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালিয়ে ৭টি বিদেশি পিস্তল, ৩০টির বেশি ওয়ানশুটার গানসহ বিপুল গোলাবারুদসহ অন্তত পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে।

কিন্তু আরসা, আরএসও, নবী হোসেন বাহিনীর মূল হোতারা থেকেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সন্ত্রাসীদের ধরতে এখন যৌথ অভিযান দরকার বলে মনে করছে সাধারণ রোহিঙ্গারা।

১৪ এপিবিএন অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মোঃ ইকবাল বলেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ধরতে আশ্রয়শিবিরে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ আরসার কয়েক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু মূল হোতারা মিয়ানমার সীমান্তে, কিছু টেকনাফের গহিন অরণ্যে অবস্থান করায় ধরা সম্ভব হচ্ছে না।

আশ্রয় শিবিরে সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিতে পোস্টার সাঁটানো প্রসঙ্গে র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এএইচ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এগুলো আরসা ও আরএসওর লোকজন করছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে শক্তি দেখানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। র‌্যাব সন্ত্রাসীদের দমনের কঠোর অবস্থান রয়েছে।

যৌথ অভিযানের ঘোষণা প্রসঙ্গে ০৮ এপিবিএন অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মোঃ আমির জাফর বিপিএম বলেন, আশ্রয় শিবিরগুলোয় সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলমান। অস্ত্রশস্ত্রসহ বহু সন্ত্রাসী ধরাও পড়ছে। তারপরও নতুন কিছু নির্দেশনা আসতে পারে।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। কিন্তু দীর্ঘ ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

বার্তাবাজার/এম আই