দুই সন্তান নিয়ে গত ৩ ডিসেম্বর গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় যান নাদিরা আক্তার পপি (৩৫)। সঙ্গে গিয়েছিলেন নাদিরার ভাই হাবিবুর রহমান (২০)। ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় ফিরতে গতকাল সোমবার রাতে ওঠেন মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে। তবে কে জানতো, এই যাত্রা হবে তাদের অন্তিম যাত্রা। মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোর পাঁচটার পরে রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ওই আগুনে পুড়ে মারা যান নাদিরা আক্তার পপি ও তার তিন বছরের শিশুসন্তান ইয়াসিন। এ ঘটনায় আরও দুজন নিহত হয়েছেন। নিহত ওই দুই পুরুষের পরিচয় এখনো শনাক্ত হয়নি।

তিন বছরের শিশু সন্তানকে বুকে আঁকড়ে ধরেই পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন নাদিরা আক্তার পপি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্ত্রী-সন্তানের এমন মরদেহ দেখে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন পপির স্বামী মিজানুর রহমান। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলছিলেন, ‘কে জানতো এভাবে আমার স্ত্রী-সন্তান আগুনে পুড়ে মরবে। আমরাতো রাজনীতি করি না, রজনীতির খোঁজও রাখি না। কিন্তু কেন আমার স্ত্রী-সন্তানকে পুড়িয়ে মারা হলো? এর জবাব কে দেবে? কার কাছে বিচার চাইবো?’

তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী পুড়ে গেছেন তবুও সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছেন। পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে, চেনাই দায়। তবুও দেখা যাচ্ছে দুই হাত দিয়ে তিন বছরের সন্তানকে জড়িয়ে ধরে আছেন।’

রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেন নিহত পপির স্বামী মিজানুর রহমান। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকায় বসবাস করতেন। বড় ছেলে রিয়াদ হাসান ফাহিম স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ৩ ডিসেম্বর দুই সন্তান নিয়ে নাদিরা আক্তার পপি যান গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায়। সেখান থেকেই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে করে ঢাকায় ফিরছিলেন তারা। নাদিরার কলেজপড়ুয়া ছোট ভাই হাবিবুর রহমানও সঙ্গে ছিলেন। তবে ট্রেনে আগুন লাগার পর বড় ভাগনে ফাহিমকে নিয়ে হাবিবুর ট্রেন থেকে নেমে যান। কিন্তু নাদিরা ও ইয়াসিন আটকা পড়ে।

মিজানুর রহমান বলেন, ‘গতকাল রাতে ট্রেনে ওঠার পর স্ত্রীর সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হয়। কথা ছিল তারা কমলাপুর স্টেশনে নামবে। সকালে খবর পাই ট্রেনে আগুন লেগেছে। এরপর হাসপাতালে এসে দেখি আমার স্ত্রী-সন্তানকে একটি সাদা ব্যাগের মধ্যে রাখা হয়েছে। পুড়ে মারা যাওয়ার পরও সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছেন আমার স্ত্রী। আমি এখন কী করবো, কার কাছে বিচার চাইবো কেউ বলতে পারবে?’

ওই ট্রেন থেকে বেঁচে ফিরেছেন হাবিবুর রহমান। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নিহত পপির ভাই হাবিবুর বলেন, ‘নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম একই পরিবারের ৯ জন। সোমবার রাতে ট্রেনে উঠি। বিমানবন্দর স্টেশনে আমাদের মধ্যে ৫ জন নেমে যান। ট্রেন বিমানবন্দর থেকে কমলাপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। আমরা জ বগিতে ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভাঙলে দেখতে পাই ট্রেনের বগি ভরে গেছে ধোঁয়ায়। আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু হয় চারদিক। তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেন থামতেই সবাই হুড়োহুড়ি করে নেমে যায়। এসময় আমার বড় ভাগনে ফাহিমকে নিয়ে আমিও নেমে যাই। কিন্তু আমার বোন নাদিরা আক্তার পপি ও তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিন বের হতে পারেনি। যখন আমার বোনের মরদেহ উদ্ধার করা হয় তখনো তার বুকে আঁকড়ে ছিল আমার ভাগনে। দুজন একসঙ্গে পুড়ে মারা গেছে। এ এক করুণ দৃশ্য।’

ঢামেকে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় পপির দেবর দেলোয়ার হোসেন টিটুর। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘পরিবারের অন্য পাঁচ সদস্যের মতো সবাই যদি বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে যেতো, তাহলে বাচ্চা ও ভাবি বেঁচে যেতেন।’

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ ও রেলওয়ে পুলিশের কর্মকর্তাদের ধারণা, দুর্বৃত্তরা যাত্রীবেশে ট্রেনে উঠে আগুন দিয়েছে। অগ্নিসংযোগকারীরা হয়তো আগুন দিয়ে বিমানবন্দর স্টেশনেই নেমে গেছে। ওই এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ওই ট্রেনের সব যাত্রীর তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫১ দিনে মোট পাঁচটি সহিসংসতার ঘটনা ঘটেছে ট্রেনে। যার শুরু হয় ১৬ নভেম্বর। টাঙ্গাইলে কমিউটার ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ওই ট্রেনের দুটি কোচ পুড়ে যায়। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় একটি কোচ। দ্বিতীয় সহিংসতার ঘটনা ঘটে ১৯ নভেম্বর। জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে দাঁড়িয়ে থাকা যমুনা এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় দুটি কোচ পুড়ে যায়। এরপর ২২ নভেম্বর সিলেটে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন উপবন এক্সপ্রেসে দেওয়া আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরেকটি কোচ। ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় ২০ ফুট রেল ট্রাক কেটে ফেলা হয়। এতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় একজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হন। ওই ঘটনায় একটি লোকোমোটিভ ও ছয়টি কোচ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে ট্রেনটি ধীরগতিতে চলছিল বলে তুলনামূলক কম ক্ষতি হয়।

এরপর সবশেষ নাশকতার ঘটনা ঘটলো আজ মঙ্গলবার ভোরে। রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনে চলন্ত ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে শিশুসহ চারজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া ট্রেনের তিনটি কোচ পুরোপুরি পুড়ে গেছে।

নিরাপদ রেলযাত্রাকে অস্থিতিশীল করতে নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা হচ্ছে বলে দাবি রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের। তিনি বলেন, ‘গত ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো যে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছে, এই সময়ে রেলে সহিংসতা বাড়ছে। রেলকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মধ্যে ফেলে হুমকি তৈরি করা হচ্ছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’

মঙ্গলবার রেলভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও নাশকতা নিরাপদ রেল চলাচলের জন্য হুমকি। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল, সেখানে একমাত্র রেল চলাচল স্বাভাবিক ছিল। এখন রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে।’

মন্ত্রী আরও বলেন, ‘যাত্রী হয়ে ট্রেনে উঠে এরপর নিরাপদ রেলে নাশকতা ঘটানো হচ্ছে। বাসের বদলে ট্রেনকে এখন প্রধান হাতিয়ার করা হচ্ছে। পরিকল্পিত দুর্ঘটনা ঘটাতে ফিশপ্লেট খুলে নেওয়া হচ্ছে।’

তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের বগিতে আগুনের বিষয়ে নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘বিমানবন্দর স্টেশন ছেড়ে তেজগাঁও আসলে ট্রেনটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে তিনটি কোচ পুড়ে গেছে। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন চারজন। রেলের নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশের সঙ্গে কথা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা হয়েছে। সন্ত্রাসীরা এসব কর্মকাণ্ড করে যেন রেল চলাচলে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’

রেলে নাশকতার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘রেলপথে সরাসরি আক্রমণের প্রথম ঘটনা ঘটে গত ১৬ নভেম্বর। টাঙ্গাইলে কমিউটার ট্রেনের দুটি বগিতে ব্যাপক ক্ষতি করা হয়। এরপর ১৯ নভেম্বর জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে যমুনা এক্সপ্রেসে পরিকল্পিত নাশকতা করা হয়েছে।’ এ দুই ঘটনায় কোনো প্রাণহানি না হলেও বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।

মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের ভেতরে যারা ছিলেন তাদের মধ্য থেকেই কেউ বা কারা আগুন দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রথমে একটি সিটে আগুন দেওয়া হয়। সেই আগুন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়।’

ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘একজনকে আমরা আহত অবস্থায় পেয়েছি, তিনি হাসপাতালে ভর্তি। তার কাছ থেকে যতটুকু জানা গেছে, ট্রেনের ভেতর যারা ছিল তারাই আগুন দিয়েছে। তিনি দেখেছেন প্রথমে একটি সিটে আগুন দেওয়া হয়। সেই আগুন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে ধোঁয়ায় চারদিক আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এসময় যাত্রীরা যে যেদিকে পারেন ছোটাছুটি করতে থাকেন। কেউ জানালা দিয়ে, কেউবা দরজা দিয়ে লাফিয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেন।’

তিনি বলেন, ‘ভোরে ঘটনা ঘটায় অনেক যাত্রী ঘুমিয়ে ছিলেন। একজন মা নাদিরা আক্তার পপি, যিনি তিন বছরের শিশুসন্তানকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন।’

যারা অবরোধ-হরতাল দিচ্ছে তারাই এই নাশকতার সঙ্গে জড়িত এমন অভিযোগ এনে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘এর আগেও তারা এভাবে ট্রেনে নাশকতা করেছে। গাজীপুরে রেললাইন কেটে ফেলা হয়েছিল এবং সেখানে একজনকে হত্যা করা হয়েছে। তেজগাঁওয়ে রেলের আগুনকেও আমি হত্যা বলতে চাই।’

হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‘যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তারা কোনো অবস্থাতেই পার পাবে না। অতীতেও পার পায়নি। বাস-ট্রেনে জ্বালাও-পোড়াওয়ের সব ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা স্বীকারোক্তি দিয়েছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে ও রাজনীতি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে।’

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের তিনটি বগিতে নাশকতার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। রেলের ডিস্ট্রিক্ট ট্রান্সপোর্ট অফিসারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে নিহত নাদিরা আক্তার পপি ও তার তিন বছরের শিশুসন্তান ইয়াসিনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। মরদেহ গ্রহণ করেন নিহত পপির স্বামী মিজানুর রহমান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগ থেকে তাদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কমলাপুর রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আহাম্মেদ বিশ্বাস  এ তথ্য জানান।

ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দুইজনের (পুরুষ) পরিচয় শনাক্ত হয়নি। তাদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

বার্তা বাজার/জে আই