উপকূলীয় এলাকা পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলা। প্রতিবছর দুর্যোগ মৌসুমে এক একটি ঘুর্নিঝড়ে বিপন্ন করে দিয়ে যায় এই অঞ্চলের জনজীবন। বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় এখানকার জেলে ও কৃষি পেশার সাথে জড়িত মানুষগুলো। প্রতিবছর দুই একজন জেলের নিখোঁজ ও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় এই দুর্যোগ মৌসুমে। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। ঘুর্নিঝড় মিধিলির প্রভাবে নিখোঁজ রয়েছেন ২৫ জন জেলে। ৬ দিন পেরিয়ে আজো খোঁজ মেলেনি তাদের।

গত শুক্রবার উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘুর্নিঝড় মিধিলির প্রভাবে রাঙ্গাবালী থেকে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে যাওয়া ট্রলারগুলোর মধ্য থেকে তিনটি ট্রলারসহ নিখোঁজ রয়েছেন ২৫ জন জেলে। তার মধ্যে রয়েছে আপন তিন বোনের তিন সন্তান ও। যাদের কারো সন্ধান না পাওয়ায় জেলে পরিবারগুলোতে চলছে হাহাকার। করো সন্তান, কারো স্বামী, কারো ভাই হারিয়ে পাগল প্রায় পরিবারের সদস্যরা। পরিবারগুলোর আহাজারিতে যেন ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস। গত পাঁচ দিনেও খোঁজ মেলেনি এসব জেলেদের।

জানা গেছে, গত বুধবার বিকেলে পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে গিয়েছিল এসব জেলে। এরপর এক দুবার যোগাযোগ করতে পারেন পরিবারের লোকজন। তবে তারপর থেকে বৈরি আবহাওয়ায় আর যোগাযোগ করা যায়নি। যেকোনোভাবে তারা জীবিত উদ্ধার হয়ে ঘরে ফিরবে এমন আশায় বুক বেঁধে আছে পরিবারগুলো। তাদের দাবি সরকারের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে যেন তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়।

স্থানীয় জেলে এবং নিখোঁজদের পরিবারগুলো ধারণা, অতীতেও এমন নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। সেসব জেলেরা ঢেউয়ের কবলে পড়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের জলসীমায় ঢুকে পড়ে সেসব দেশের সংশ্লিষ্ট বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকে। এবারেও হয়তো এমন কিছু হয়েছে। তারা এখনো জীবিত আছেন বলে সবার বিশ্বাস।
নিখোঁজ জেলেদের একজন জিসান মাহমুদ (২১)। তার মায়ের সাথে কথা হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তিনি বলেন, আমার বাবা সাগর ভয় পায়। আমার অভাবের সংসার। আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার ছেলে চিকিৎসা করানোর জন্য ইনকাম করতে সাগরে গেছে। বুধবার বিকেলে গেছে বাড়ি থেকে। এরপর ট্রলারে উঠে একবার কথা হয়েছিলো। আর কোন যোগাযোগ করতে পারিনাই। আমার বাবার ফোনে অনেক কল করছি কিন্তু আমার বাবার ফোন বন্ধ। সরকারের কাছে দাবি আমার বাবারে যেন ফিরাই আইনা দেয়।

এদিকে ট্রলার মালিকরা বলছেন, গত বুধবার সকালে গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করার উদ্দেশ্য ট্রলার ছেড়ে যায়। কিন্তু পরে ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র পর আর তাদের সাথে কোন যোগাযোগ করা যায়নি। তারা কোথায় আছে, কীভাবে আছে, কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি এখনো।

কোড়ালীয়া লঞ্চঘাট মৎস সমিতির সভাপতি জহির হাওলাদার বলেন, তারা ডুবে যায়নি এটা আমাদের বিশ্বাস। কারন তাহলে অন্তত ২৫ জন জেলের একটি লাশ হলেও পাওয়া যাইতো। আমরা ধারণা করছি হয়তো সুন্দরবনে রয়েছে। নয়তো ভারত বা অন্য কোন দেশে ঢুকে পড়েছে তারা। আমরা কোস্ট গার্ড , নেভিসহ বিভিন্ন বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে জানিয়েছি। এছাড়াও সবার পরিবারের লোকজন সাগর এবং দেশের মধ্যের সম্ভব্য এলাকাগুলোতে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, জেলে ট্রলারগুলোর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য ট্রলারে জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইস, নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানার জন্য রেডিও সিস্টেমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ও মেরিন সায়েন্স অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমাদের যে সকল জেলেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরী। প্রতিটি ট্রলারের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য অবশ্যই জিপিএস ট্র্যাকার এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য রেডিও সিস্টেম সুবিধাসহ অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জাম থাকা দরকার। যাতে করে জেলেদের অবস্থান সম্পর্কে আমরা জানতে পারি এবং তারা বিপদে পরলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে পারে এমন ব্যবস্থা থাকা জরুরি। তিনি আরো বলেন, উপকূল থেকে যেসকল ট্রলার মাছ ধরার জন্য ছেড়ে যায় সেগুলোতে যথেষ্ট পরিমান লাইফ জ্যাকেট আছে কিনা সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ আমরা যদি এই জেলেদের নিরাপত্তা দিতে না পারি তাহলে অনেকেই এই পেশা থেকে সরে আসবে। এতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।’

এছাড়াও সাগরে বিভিন্ন অপারেটরের মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু করার দাবি জেলেদের।

মৎস্য বিভাগ থেকে জানা গেছে, এ উপজেলায় এপর্যন্ত নিবন্ধিত জেলে সংখ্যা মোট ১৬ হাজার ৮১৭জন। এদিকে, নিবন্ধিত ৫ হাজার ১৫১ জন ও অনিবন্ধিত রয়েছে আরও ৩ থেকে ৪ হাজার জেলে। যাদের বেশিরভাগই মৎস্য শিকার করেন বঙ্গোপসাগরে।

পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় মিধিলিতে উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কাউখালী গ্রামের বাসিন্দা হাসান জোমাদ্দারের ট্রলারের ৮ জন, মৌডুবী ইউনিয়নের কাজিকান্দা দিদার মৃধার ট্রলারের ৮ জন ও একই এলাকার হিমু হাওলাদারের মালিকানাধীন ট্রলারের ৯ জন জেলে নিখোঁজ হয়।

এবিষয়ে রাঙ্গাবালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি নুরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, তিনটি ট্রলারসহ ২৫ জন জেলে ও ট্রলার নিখোঁজ রয়েছেন। তাদেরকে খোঁজাখুঁজি করা হচ্ছে। আমরা খোঁজাখুঁজির অভিযান অব্যাহত রেখেছি। মালিক পক্ষ ও খোঁজাখুঁজি করছে। ইনশাআল্লাহ আমরা চেষ্টা করছি তাদের একটি সন্ধান যেন পেতে পারি। আমরা সার্বক্ষণিক এবিষয়ে খোঁজখবর রাখছি। বিষয়টি উর্ধ্বতণ কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করা হয়েছে।

উল্লেখ্যঃ এর আগের বছরগুলোতেও রাঙ্গাবালী থেকে নিখোঁজ, নিহত জেলের সংখ্যা রয়েছে অনেক। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে তাদের পরিবারগুলো। তবে প্রসাশনের কাছে নেই তাদের নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য। কোন প্রকার সহায়তার আওতায় ও আসেনি এই পরিবারগুলো।

বার্তা বাজার/জে আই