কয়েকদিন আগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস পরিদর্শন করেছেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। সফরকালে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী।

সফরে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত যেসব বাংলাদেশিরা যারা এখন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, তাদের স্ব-স্ব এলাকায় আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। একই সাথে যুক্তরাজ্য সফরকালে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন এবং মতবিনিময় করেছেন। হাউস অফ কমন্সের সদস্য রওশন আরাসহ অন্যান্য এমপিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য সরকারের কমনওয়েলথবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে। রাজ্যে নিয়োজিত বাংলাদেশের হাইকমিশনারের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।

যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য— দুই দেশে অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী যে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন তাতে দুই দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি মূল্যায়নের সুযোগ ঘটেছে। অন্যের কাছে জেনে একটি বিষয় অনুধাবন করা এবং নিজ চোখে দেখে অনুধাবন করা—দুটি বিষয়ের মধ্যে একটি গুণগত পার্থক্য রয়েছে। আলোচ্য সফরকালে নিজে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা প্রধানমন্ত্রীর জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে বলে মনে করি।

সম্প্রতি সেতুমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেছেন, তলে তলে সব আপস হয়ে গেছে। এই বক্তব্য ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা আলোচনা। অনেকে এটাকে প্রধানমন্ত্রীর সফরের সাথে মিলিয়ে দেখছেন। সেতুমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন তিনি এ বিষয়ে অবগত নন।

প্রধানমন্ত্রীর এই দুই রাষ্ট্র সফরকালে সফরসঙ্গী ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। প্রধানমন্ত্রীর সফর প্রসঙ্গে তিনি কোনো কিছু খোলাসা করেননি। ফলে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য ঘিরে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সেতুমন্ত্রী একই সঙ্গে মন্ত্রী এবং সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক। তিনি তার দলের নেতাকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এবং তাদের চাঙ্গা করার জন্যও এমন বক্তব্য দিয়ে থাকতে পারেন।

এদিকে আমাদের একাধিক নির্বাচন কমিশনার ঘোষণা দিয়েছেন, তারা সম্ভবত আগামী নভেম্বরে নির্বাচনের তাফসিল ঘোষণা করতে সক্ষম হবেন। একই সঙ্গে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। একজন নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। তা না হলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা দেখা দেবে।

নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের জন্য কী কী উপকরণ প্রয়োজন হবে অথবা কী কী পরিকল্পনা দরকার সেগুলো জানিয়েছেন। তারা এটাও জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচন ব্যালট পেপারের মাধ্যমে হবে, ইভিএম এর মাধ্যমে নয়। নির্বাচন কমিশন আরও জানিয়েছে, নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যালট পেপার নির্বাচন কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হবে নির্বাচনের দিন সকালে, যা আগে পৌঁছে দেওয়া হতো নির্বাচনের আগের দিন রাতে। নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট করেছে যে, তারা সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করার জন্য তফসিল ঘোষণার আগের দিন পর্যন্ত সচেষ্ট থাকবেন। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাকিটা নির্ভর করবে দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থানের ওপরে।

৪ অক্টোবর অস্ট্রেলীয় সিনেটের ১৫ জন সদস্য সে দেশের প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি পাঠিয়ে বাংলাদেশের ওপর ম্যাগনেটস্কি ধরনের স্যাংশন প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল এ ধরনের অবস্থান গ্রহণের চিন্তা করতে পারে সেটা আমরা আগেও বলেছি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের যদি কোনো সমাধান না হয়, যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি পরিষ্কার না হয়, তাহলে হয়তো অক্টোবরের মাঝামাঝি নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং তাদের মিত্ররা অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ঘোষণা করে বসতে পারে।

অক্টোবরের ৭ তারিখে ৬ সদস্যের মার্কিন প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক টিম বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। তারা দেশে ফেরার পর হয়তো আমেরিকা তার অবস্থান পরিষ্কার করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা যদি নির্বাচনের আগেই তাদের অবস্থান ব্যক্ত করে, তারা যদি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ না করার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে পরিস্থিতিটা ভিন্ন মাত্রা লাভ করবে। তখন হয়তো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করাটা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

সাধারণত নির্বাচন আয়োজন করা কোনো কঠিন বিষয় নয়। কিন্তু অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করাটাই কঠিন। আর এটাই নির্বাচনের ট্রিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। যেহেতু আমাদের শাসক দল এবং সরকার বারংবার সংবিধানের রেফারেন্স টানছেন, তাই সংবিধানসম্মত পদক্ষেপ জরুরি অবস্থার আশঙ্কা থেকেই যায়। যদি পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যায় তখন হয়তো এই মহৌষধটি প্রয়োগ করে বসতে পারে সরকার।

অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ : শিক্ষাবিদ; রাজনীতি বিশ্লেষক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংগঠন জানিপপের চেয়ারম্যান

(বার্তা বাজারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বার্তা বাজার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বার্তা বাজার নিবে না।)