পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় বোয়ালমারী দ্বি-মূখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২১-২২ শিক্ষাবর্ষের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলো মোট ৪২ জন। ৪২ জন শিক্ষার্থীই এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ও ফরম ফিলাপ করলেও পরীক্ষা দিয়েছেন মাত্র ৮ জন। ৩৪ জনেই ওই স্কুলের বাল্য বিবাহে শিকার। আটজন ওই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিলেও পাশ করেছে মাত্র ৪ জন। মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমলেও থেমে নেই বাল্য বিবাহের প্রকোপ। প্রতিনিয়তই বাড়ছে বাল্য বিবাহ। ওই স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার এমন ফলাফলে আলোচনায় উঠে এসেছে সব মহলে। প্রতিষ্ঠান নিয়ে নানান ধরের আলোচনা সমালোচনা করতছেন সচেতন মহল। বোয়ালমারী দ্বি-মূখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি ১৯৯৪ সালে স্থাপিত হয়। ২০০২ সালে এমপিও ভুক্ত হয়। ২০২২ সালে একটি নতুন ভবন স্থাপন হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ১০ জন শিক্ষক রয়েছেন। পাঁচজন অফিস কর্মচারী রয়েছে।

ফলাফলের এমন বিপর্যয়ের ঘটনায় মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) দুপুরে ওই স্কুলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা বাংলাবান্ধা মহাসড়কের ডান পাশের বিদ্যালয়টি। বিদ্যালয়টিতে রয়েছে একটি খেলার মাঠ। পাশে চা-বাগান ও প্রাইমারি স্কুল। মনোরম সৌন্দর্যে ভরপুর স্কুলটি।

স্কুলের ফলাফল নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে কথা বলা হলে তারা বলেন, প্রতি বছর শিক্ষার মান নিয়ে বিপর্যয় ঘটেছে। এর মূল কারণ অল্প বয়সে শিক্ষার্থীদের বিয়ে দেওয়া। এক শ্রেণীর দালাল অভিভাবকদের ম্যানেজ করে নানান প্রলোভন দেখিয়ে অভিভাবকদের সন্তুষ্ট করান। গোপনে বিয়ে দিয়ে থাকেন। বিয়ের পর লজ্জাই আর স্কুল আসতে চাই না। তাই এই স্কুলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিয়ে হওয়াই এসএসসি পরীক্ষা দেননি।

ওই স্কুলের হাসিনা নামের সহকারি শিক্ষক জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত অষ্টম শ্রেণির ১০ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশকয়েক জনের গোপনে বিয়ে হয়েছে।

মোঃ রহমত আলী নামের সহকারি শিক্ষক বলেন, আমাদের এই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে, উত্তর বোয়ালমারী, দক্ষিণ বোয়ালমারী, ছোপাগছসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে। তবে অধিকাংশ অভিভাবক অশিক্ষিত। রাতের আধারে অল্প বয়সের মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছে। আমরা স্কুল থেকে বেশ কয়েক বার পদক্ষেপ নিয়েছিলাম তারপরেও কাজ হচ্ছে না। বাল্য বিবাহের প্রকোপ কোনতেই কমছে না।

মোছাঃ সাবরিনা আক্তার দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, ১৫ জন শিক্ষার্থী ছিলাম নবম শ্রেণীতে। ১০ দশম শ্রেণিতে উঠে দেখি মাত্র ছয়জন। বাকি সব ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। আমরা বাল্য বিবাহ বন্ধ চাই। এই স্কুলে বাল্যবিবাহ ব্যাপক আকার ধরন করছে।

মোছাঃ জেবুন আক্তার জেসি অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি যখন ক্লাস সিক্সে আমার বাবা মা তখন বিয়ে দেন। অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ায় সংসার করতে পারিনি। আবার স্কুলে ভর্তি হই। আমি বর্তমানে অষ্টম শ্রেণিতে। এইভাবে আমার অনেক বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে। তারা আজকে দুই তিন সন্তানের মা।

১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে ওই স্কুলের এক শিক্ষার্থীর মোছাঃ বৈশাখীর বাড়িতে গেলে তার মা মোছাঃ ফুলবানু বেগম বলেন, দেশের পরিস্থিতি খারাপ কখন কি হয় এই জন্যই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছি। পরীক্ষার ফলাফল খারাপ নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে রয়েছে পরস্পর অভিযোগ।

অভিভাবকরা শিক্ষকদের দায়ী করে বলেন, শিক্ষকদের অবহেলার কারণেই এমন বিপর্যয় ঘটেছে। স্কুলের প্রতি গুরুত্ব কম। তারা ঠিকমত শিক্ষার্থীদের সেভাবে তৈরি করতে পারে না।

শালবাহান ইউনিয়নের বর্তমার চেয়ারম্যান আশরাফুল বলেন, বোয়ালমারী এলাকায় একটি সিন্ডিকেট বাল্য বিবাহের সঙ্গে জড়িত। তারা রাতের আধারে অন্য ইউনিয়নে নিয়ে বাল্য বিবাহ দিচ্ছেন। তিনি প্রশাসনের সহযোগীতা প্রার্থনা করেন।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে সত্য। এটা শিক্ষকদের সমস্যা নয়, অভিভাবকদের সমস্যা। নিজেদের অর্থায়নের শিক্ষার্থীর ফরম ফিলাপ করে দেওয়ার পরেও পরীক্ষায় অংশ নেননি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রবেশ পত্র দিয়ে এসেছি।

সভাপতি মোঃ আকবর বলেন, এই এলাকার মানুষ সচেতন নই। যার কারণে বাল্য বিবাহ বাড়ছে। শিক্ষা অফিসার শওকত আলী জানান, বিষয়টি অনেক দুঃখজনক। আমাকে কোন দিন এই বিষয়ে জানায়নি প্রধান শিক্ষক।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, বিষয়টি নিয়ে তারা সচেষ্ট রয়েছেন। তেঁতুলিয়ায় কয়েকটি স্কুল ভালো রেজাল্ট করলেও বোয়ালমারী স্কুলটির ঘটনাটি দুঃখজনক। আর যেন কোন শিক্ষার্থী বাল্য বিবাহে শিকার না হয় এই ব্যাপারে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে।

বার্তাবাজার/এম আই