কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের আলোচিত দীনেশ চন্দ্র হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী ফাঁসির কয়েক ঘণ্টা আগে প্রাণভিক্ষা পাওয়া সেই বীর মুক্তিযুদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহা মুক্ত হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি বর্তমানে খুবই অসুস্থ। হাঁটাচলা করতে পারছেন না।

রাখাল চন্দ্র নাহারের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এখন তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু অর্থাভাবে তাকে উন্নত কোনো হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।

রাখাল চন্দ্র নাহার পরিবার জানায়, সে ছিল সদা হাস্যোজ্জ্বল ও স্বজনদের সাথে সদালাপী। অনেক স্বজনের মাঝেও এখন সেই বীর মুক্তিযুদ্ধা ভুগছে একাকিত্বে। ফাঁসির দন্ড থেকে রক্ষা পাওয়ার পর যাবজ্জীবন কারাগারে থাকার স্মৃতিতে কাতর রাখাল নাহারের দিন কাটে একাকী ঘরে। তবে রাখাল চন্দ্রের এমন জীবনযাপনে চিন্তিত রয়েছে পরিবার। উদ্বিগ্ন রয়েছেন তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা।

রাখাল চন্দ্র নাহারের ছেলে সঞ্জয় চন্দ্র নাহা বলেন, তার বাবা রাখাল নাহারের দুই হাঁটুতে কালো দাগ রয়েছে। হাঁটুর ব্যথায় হাঁটতে পারে না সে। সদালাপী রাখাল নাহা এখন কারো সাথে কথা বলে না। খেতে চায় না কিছুই। নিজের ঘরে সব সময় চুপচাপ থাকে সে। কখনো কখনো কাঁদে রাখাল নাহা। রাখাল জেলে যাওয়ার আগে যে ঘরে থাকে সেই ঘরের সাথে তার অনেক স্মৃতি। ঘুমের ঘোরেও সে কেঁদে ওঠে, মাঝে মধ্যে চিৎকার করে রাখাল।

তিনি আরো বলেন, তার বাবা রাখাল চন্দ্র নাহা বর্তমানে অনেক অসুস্থ। তার এখন উন্নত চিকিৎসা দরকার। আমরা আপনাদের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট সাহায্য চাই। সাহায্য পেলে তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। আপাতত চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে তার চিকিৎসা চলছে।

রাখাল চন্দ্র নাহার স্ত্রী গীতা রানী নাহা (৬৫) বলেন, রাখাল চন্দ্র নাহার খাওয়া নেই, ঘুম নেই। উদাসীনভাবে একেক সময় একেক দিকে তাকিয়ে থাকে রাখাল চন্দ্র নাহা। তার সাথে আমি কথা বলেছি। তার পেটে ও বুকে ব্যথা। আমরা এ মুক্তিযুদ্ধাকে নিয়ে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন।

শুক্রবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে জানাযায়, মৃত্যুদণ্ড মওকুফ পাওয়া এই মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র ২৫ বছর পর মুক্তি পেয়েছেন। ২০০৮ সালের ৭ এপ্রিল রাত ১১টায় একটি হত্যা মামলায় ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার।

কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষও ফাঁসির যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। রাখাল চন্দ্র নাহা গোসল করে হালকা শুকনো খাবার খেয়ে ফাঁসির সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। সেদিন রাত ১১ টায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাত্র দেড় ঘন্টা পূর্বে কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসির দন্ডাদেশ মওকুফের ওয়ারলেস বার্তা পান।

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিনের নিকট আবেদন করলে রাষ্ট্রপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার মৃত্যুদন্ডাদেশ মওকুফ করে যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখেন।

যাবজ্জীবন অন্ধকার কারাগারে থাকার পর গত রবিবার (২ জুলাই) সকালে তাকে কুমিল্লা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। মৃত অক্ষয় চন্দ্র নাহার ছেলে বীর মুক্তিযুদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার হোসেনপুর গ্রামে।

খোঁজ নিয়ে মামলার বিবরণে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে জমি জমা নিয়ে পূর্ব শত্রুতার জেরে জেঠাতো বোনের জামাই দীনেশ চন্দ্র দত্তকে হত্যার অভিযোগে বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহা ও তার ভাই নেপাল চন্দ্র নাহার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করে দীনেশের পরিবার। মামলার পর রাখাল চন্দ্রকে আটক করা হলেও নেপাল চন্দ্র নাহা কয়েক বছর পলাতক থাকার পর মারা যান।

ওই মামলায় ২০০৩ সালের ২০ জানুয়ারী বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। রাখাল চন্দের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করা হলে পরে ওই মৃত্যুদন্ড মওকুফ করার জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ কাছে জোর দাবি জানান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হুমায়ুন কবির ও সাবেক সেনা প্রধান মঈন ইউ আহমেদসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীরা।এরপর ২০০৮ সালের ৩০ জুন তার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন সাজা দেন রাষ্ট্রপতি।

শুক্রবার সকালে রাখাল চন্দ্র নাহার নিজ বাড়িতে বসে জেলের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ভগবান আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমার মৃত্যুদন্ড মওকুফের খবর পেয়ে পুরো কারাগারেও আনন্দ করেছে অন্য কয়েদী ও সাধারণ আসামীরা।

সবাই জানত রাতে আমার ফাঁসি কার্যকর হবে। এজন্য দিনের বেলাও অনেক আসামী ও কয়েদী পুলিশ আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। সেদিন রাত ১১ টায় আমার ফাঁসির সময় দেওয়া হয়েছিল। আমি গোসল ও হালকা শুকনো খাবার খেয়ে সেলে বসে ছিলাম। বুক তখন ধরফর করে কেপে উঠছিল, চোখে মুখে বাঁচার আকুতি ছিল, সেলে কেউ আসলেই মনে হতো এই বুঝি আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে নিয়ে যেতে এল ! কারা পুলিশ আমাকে শেষ খাবার খাওয়াতে এসেছিল, আমি তখন কিছুই খায়নি।

একটু পর পরই ডাক্তার আসে শরীর পরীক্ষা-নিরিক্ষা করতে। আমার বুক ধরফর করতে দেখে আমাকে বলেছিল আমি যেন শান্ত থাকি। মৃত্যুদন্ডের দেড় ঘন্টা আগে এক কারা পুলিশ এসে আমাকে জানায় রাষ্ট্রপতি নাকি আমার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করেছে। আমি সে দিন আনন্দে চিৎকার দিয়েছিলাম। বিনা অপরাধে অন্ধকার কারাগারে ২৫টি বছর পার করেছি। কারাগারের একদিন ছিল আমার কাছে ১ হাজার বছরের মত।

যেদিন দীনেশ কে হত্যা করা হয় সেদিন আমি বাড়ি ছিলাম না, আমার সম্পত্তি ভোগ দখল করার জন্য আমাকে দীনেশ হত্যায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। আমি মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। এ দেশই আমাকে বিনা কারণে ২৫ বছর কারাগারে রেখেছে।

বার্তাবাজার/রাহা