“হঠাৎ দাম বেড়ে গেলে তা এড়িয়ে চলুন, হোক তা মানুষ বা তরমুজ। দেখবেন পচে গেলে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে।” সিন্ডিকেটের প্রভাবে তরমুজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ঠিক এভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে মৌসুমী সুস্বাদু ফল তরমুজ কিনতে অন্যদের নিরুৎসাহিত করছেন অনেকেই।

কেনই বা করবে না! যেখানে প্রান্তিক পর্যায়ে একজন কৃষকের কাছ থেকে পিচ হিসেবে কিনে নেওয়ার পর হাতবদল হয়ে শহরের বাজারগুলোতে তা বিক্রি হচ্ছে কেজি দরে। সে হিসাব ধরলেও কৃষকের কাছ থেকে ৭ থেকে ১০ কেজির একটা তরমুজ পিচ হিসেবে সর্বোচ্চ ২৭০ টাকা দরে কিনলেও ঢাকার বাজারে কেজি হিসেবে তার দাম ৬-৭ শত টাকা দরে কিনতে হয় ক্রেতাদের। এজন্য মধ্যস্বত্বভোগীকেই দায়ী করেছেন কৃষক ও ভোক্তারা।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলা তরমুজ উৎপাদনে সুনাম অর্জন করেছে বহুবছর আগেই। দেশের বাজারের সিংহভাগ তরমুজ সরবরাহ হয়ে থাকে এই এলাকা থেকে। তবে এক জমিতে বারবার তরমুজ উৎপাদনে জমির মান কমে গিয়ে গত দু’বছর ধরে নানামুখী সমস্যায় উৎপাদন কমেছে তরমুজের। তবুও প্রতিবছর স্বপ্ন বুনে যাচ্ছেন প্রান্তিক এলাকার চাষীরা। তবে ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারাও। প্রান্তিক এলাকার চাষীদের দাবি ঢাকার বাজারে এভাবে লাগামহীন দাম বৃদ্ধি পেতে থাকলে ক্রেতারা এই ফল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন এবং এর প্রভাব সরাসরি প্রান্তিক পর্যায়ের চাষীদের উপরেই বর্তাবে। কারণ তরমুজ একটি পচনশীল কৃষিজাত পণ্য। বেশিদিন মজুদ করার সুযোগ নেই এর। ক্রেতারা না কিনলে মাঠেই স্বপ্ন ভেঙে যাবে তাদের।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এবার রাঙ্গাবালী উপজেলায় ইতোমধ্যে ৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে তরমুজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর জমি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং পরিবেশ অনুকূলে থাকলে সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদনের আশা ব্যক্ত করেছিল কৃষি বিভাগ। গত বছরে আবাদি এ জমির পরিমাণ ছিল ৮২৬২ হেক্টর। বিগত দুই বছরে রোগ ও পোকামাকড়ের ব্যাপক আক্রমণের ফলে এ বছর আবাদ হ্রাস পায়। এছাড়াও চলতি বছরে রোগের আক্রমণে প্রায় ৩৫ হেক্টরের মত তরমুজের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেক্ষেত্রে উৎপাদন ও আবাদ কম হওয়ায় ৩৫০ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।

উপজেলার কাউখালী এলাকায় প্রায় ১৩ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ করেছেন ছোট বাইশদিয়ার চাষি মিঠেল হাওলাদার। শুরুতেই জমির মাটি সমস্যায় তার প্রায় তিন হেক্টর জমির গাছ মরে গেছে। সব সমস্যার পরেও যা ফলন হয়েছে তাতেও লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি। কিন্তু ঢাকার এই মধ্যস্বত্বভোগীদের না থামাতে পারলে তাদের অনেকের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ”অনেক কষ্ট করে আমরা এই ফসল উৎপাদন করি। সারাবছর অপেক্ষার পরে আমরা এই মৌসুমে তরমুজ চাষ করে থাকি। লটারির মতো করে অনেকেই সফল হয় অনেকে আবার দেশান্তরী হয়। তবুও আমরা থেমে থাকি না। এবার গত বছরগুলোর চেয়ে আমার অনেক বেশি টাকা খরচ হয়েছে। তবুও আমি লাভের আশা করছি।

কিন্তু ঢাকায় শুনি কেজি প্রতি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে এবং যে দাম তা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। এভাবে চলতে থাকলে একদিকে যেমন আমরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছি না অন্যদিকে এই ফল বেশিরভাগ শহরের বাজারে বিক্রি হয়। সেখানকার ক্রেতারা না কিনলে এর মূল্য কমে যাবে। হতে পারে ক্ষেতেই নষ্ট হবে তরমুজ। তাতে করে আমার মতো কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”

এদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রাঙ্গাবালীতে আসা আড়ৎদার ও তাদের প্রতিনিধিদের দাবি, ”তারা ঠিক দামে বিক্রি করলেও কারসাজি হয় খুচরা বাজারে। এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না তারা।”
একজন তার মেয়ে এবং একজন ছেলের পরিবারের জন্য দুটো করে তরমুজ নিয়ে রাঙ্গাবালী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন উপজেলার রাঙ্গাবালী এলাকার বাসিন্দা তোফায়েল পণ্ডিত ও ভূঁইয়ারহাওলা এলাকার বাসিন্দা শহিদ হাওলাদার।

পৃথকভাবে কথা হয় তাদের সাথে। এত দূর থেকে কেন দুটো তরমুজ নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করতেই প্রথমেই দামের পার্থক্যের কারণে বললেন তারা। তাদের দাবি এখানকার বাজারের থেকে ঢাকায় এর দাম দ্বিগুণ কোনো কোনো জায়গায় তিনগুণ। এত দাম দিয়ে স্বজনরা কিনতে পারে না বলেই রাঙ্গাবালী থেকে নিয়ে যাচ্ছেন তারা।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ”প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ২৫-৩০ টন তরমুজ উৎপাদিত হয়ে থাকে। কৃষকরা তরমুজ পিস হিসাবে বা সমগ্র খেতের তরমুজ একত্রে বিক্রি করে দেয়। সেক্ষেত্রে দেখা যায় প্রতি কেজি তরমুজের দাম ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত সর্বোচ্চ দাম কৃষক পায়।

কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা পিচ হিসেবে ক্রয়কৃত তরমুজ ৮০-১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে থাকে। ফলে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং চাষীদের কাছে অবিক্রিত তরমুজের দাম ফড়িয়ারা খুব কম দিতে চায়। অসাধু ব্যবসায়ীদের এই সিন্ডিকেটের ফলে ভোক্তারা যেমন ন্যায্যমূল্যে সুস্বাদু এই ফল খাওয়া থেকে বিরত হচ্ছে তেমনি কৃষকরাও উপযুক্ত মূল্য থেকে বিরত হচ্ছে।”