বাবা গাছ কেনাবেচা সহ লাকড়ির ব্যবসা করেন, মা বাসায় কাজ করেন। তাই তারা দুইজন বাইরে থাকায় এবং প্রতিবন্ধী বড় ভাই স্কুলে যাওয়ায় শিশু আবু বকর সিদ্দিক ওরফে সাকিব ওরফে সোহাগ (৫) কে ঘরের ভিতরে রেখে বাইরে তালা দিয়ে যায় বাবা-মা। এরপর নিয়তির নির্মমতায় বৈদ্যুতিক সর্ট-সার্কিটের ফলে দুই রুমের টিনশেড ঘরে লাগে আগুন। এলাকাবাসী এবং ফায়ারসার্ভিস এসে আগুন নিভাতে নিভাতে শিশু সাকিব পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। পরে ভস্মীভূত খাটের নিচ থেকে তার মাথা ও পা আলাদা অবস্থায় সম্পূর্ণ পোড়া শরীর উদ্ধার করা হয়। তাই সকলে ধারণা করছে, আগুনের তীব্রতায় বাঁচার জন্য শিশু সাকিব খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু তার শেষ রক্ষা আর হলনা।

রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টায় আশুলিয়া থানাধীন পাথালিয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের পানধোয়া এলাকায় বাবু মুন্সী নামের ব্যক্তির ভাড়া দেওয়া টিনশেড বাসায় এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শী দেওয়ান মো: সাজেদুর রহমান জানান, আনুমানিক সকাল এগারোটায় আগুনের সূত্রপাত। ধারণা করছি কারেন্ট থেকে আগুন লাগে। কারণ ঘরের ভিতরে একটি গ্যাস সিলিন্ডার অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তাই প্রথমে মনে করেছিলাম সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লেগেছে। কিন্তু সেটা বিস্ফোরিত না হওয়ায় বৈদ্যুতিক সর্ট-সার্কিটের ফলে আগুন লাগার সম্ভাবনাই বেশী।

তিনি আর বলেন, আগুন লাগার পরে এলাকাবাসী প্রথমে নিজেরাই আগুন নিভানোর চেষ্টা করায় ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে দেরী হয়। দুপুর বারটায় তাদেরকে খবর দিলে তারা সাড়ে বারটায় ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়। আর বাচ্চাটার বয়স আনুমানিক চার-পাঁচ বছর। তাকে ঘরে রেখে বাবা-মা বাইরে থেকে তালা দিয়ে কাজে বেরিয়ে যায়। এজন্য যখন আমরা এটা জানতে পারি, তখন হয়তো আরেকটু চেষ্টা করলে আমরা বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু আগুনের তীব্রতায় আমাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

নিহত বাচ্চার বাবা মো: নিজামুদ্দিন ওরফে সুমন নির্বাক হয়ে বসে ছিলেন। মা ছিলেন আহাজারিতে ব্যস্ত। নিহত সাকিবের দাদা মো: মনির উদ্দিন জানান, ঘটনার সময় আমি, আমার ছেলে এবং তার স্ত্রী কেউ বাসায় ছিলাম না। তাই কয়টায় আগুন লাগছে এটা আমি বলতে পারবো না। আমার ছেলে গাছ কেনাবেচার ব্যবসা ও লাকড়ি বিক্রি করে। ঘরে ব্যবসার ২/৩ লাখ টাকা ছিল, সব শেষ হয়ে গেছে।

জিরাবো মডার্ণ ফায়ার সার্ভিস এর সিনিয়র স্টেশন অফিসার আবু সায়েম মাসুম বার্তা বাজারকে জানান, আগুনের সূত্রপাত কীভাবে তা এখনো নিশ্চিত নই আমরা। তবে লোকজন বলছে বিদ্যুতের থেকে আগুন লেগেছে। তবে এবিষয়ে তারাও কনফার্ম না। এব্যাপারে পরে জানানো হবে।

তিনি আরও বলেন, যে রুমটা থেকে আগুনের সূত্রপাত যেটা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ ছিল। আমরা খবর পাই দুপুর ১২টা ২ মিনিটে। এরপর দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করি। পরে ঘরের ভিতর থেকে বাচ্চার পুড়ে যাওয়া খন্ড বিখন্ড মরদেহ উদ্ধার করি। টিনশেড ঘরটির দুইটি কক্ষই সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গেছে। আনুমানিক তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছি।

প্রসঙ্গত, নিহত সাকিব এর বড় এক ভাই প্রতিবন্ধী এবং সে স্কুলে পড়ালেখা করে। এই প্রতিবন্ধী ছেলেটির স্কুলে নিয়ে আসা-যাওয়ার কাজটি করতো তার মা। এখন সে বড় হওয়ায় একাই চলাফেরায় সক্ষম। বছর পাঁচেক আগে সুস্থ সন্তান হিসাবে সাকিবের জন্ম হওয়ায় নিজামুদ্দিন ও রিনা দম্পতি বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন। দুই বাচ্চাকে মানুষ করতে দুজনেই কর্মজীবি হিসাবে আয় করছিলেন। এজন্য ছোট ছেলেকে বাসায় রেখে ঘর বাইরে থেকে তালা দিয়ে দু’জনেই কাজে বেরিয়ে যেতেন। চাবি পাশের কোনো এক বাসায় রেখে যেতেন। কিন্তু যখন বিপদ এলো, তখন আর ওই চাবি দিয়ে তালা খুলে শিশুটিকে বাঁচাতে পারলো না কেউ।

আশুলিয়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে মরদেহের সুরতহাল করলেও পরিবারের এবং এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্তের জন্য খন্ডিত মরদেহ নেওয়া হয় নাই। শিশু সাকিবের এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ্য, বিভিন্ন টিনশেড বাসাবাড়ি গুলোতে বৈদ্যুতিক ওয়ারিং এর কাজটি যেনতেন ভাবে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম দিয়ে করা হয়। তাই সেখানে যেকোনও সময় সর্ট-সার্কিট হয়ে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর শিশু সাকিবের মতো নির্মম মৃত্যু অপেক্ষা করে যা কারও কাম্য নয়।

বার্তা বাজার/জে আই