দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন কুমিল্লার ১১টি আসনের মধ্যে ৪টিতে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এ জয় পেয়েছেন।

কুমিল্লা-২ (হোমনা ও মেঘনা) আসনে অধ্যক্ষ মো. আবদুল মজিদ, কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনে জাহাঙ্গীর আলম সরকার, কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) আসনে মো. আবুল কালাম আজাদ ও কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া) আসনে এম এ জাহের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছেন।

এই চারজনই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদধারী নেতা। তারা দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। তারা স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন এবং নির্বাচনে প্রতীকী প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেও জয়ী হতে সক্ষম হন।

এই চার স্বতন্ত্রদরা ৪ নৌকার প্রার্থীকে হারিয়েছেন। এবার দল হিসেবে জাতীয় পার্টি থেকে বিজয়ী হয়েছেন ১১ জন। প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসতে যে পরিমাণ আসন দরকার জাতীয় পার্টি সে পরিমাণ আসন পায়নি। কুমিল্লার ৪টিসহ জাতীয় পার্টির থেকে ৬ গুণ বেশি আসন পেয়েছে স্বতন্ত্ররা। তাই রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে প্রধান বিরোধী দলের আসনে জাতীয় পার্টি না কী স্বতন্ত্র জোট বসতে যাচ্ছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন দল হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দ্বিতীয় স্থানে থাকা জাতীয় পার্টিই হবে প্রধান বিরোধী দল। এরপর থেকে আলোচনা তাহলে শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র জোট কী হচ্ছে না? যদি না হয় তাহলে সংসদে তাদের অবস্থান কী হবে?

এই কানাঘুষার মধ্যেই আগামী রবিবার স্বতন্ত্র এমপিদের গণভবনে ডেকেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন সন্ধ্যায় এমপিরা গণভবনে যাবেন। প্রধানমন্ত্রী কী নির্দেশনা দেন, সেই অপেক্ষায় আছেন তারা। এরপরই সিদ্ধান্ত নেবেন স্বতন্ত্র এমপিরা এলে কী করবেন? তবে স্বতন্ত্রদের কুমিল্লার ৪ এমপি-ই বলছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আমাদের প্রধান নেতা। আমরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেই আছি। স্বতন্ত্র হলেও নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার তুলে ধরেই জনগণের কাছে ভোট চেয়েছি। সরকারের টানা ১৫ বছরের উন্নয়নের কথা বলেছি। কাজেই আমাদের আদর্শ-উদ্দেশ এক ও অভিন্ন। সুতরাং দলীয় প্রধান যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই আমরা মেনে নিয়ে পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ নেব।

কুমিল্লা- ২ (হোমনা- মেঘনা) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ। তিনি হোমনা উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি। তার স্ত্রী রেহেনা মজিদ হোমনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, আমি স্বতন্ত্র এমপি। আওয়ামীলীগের সঙ্গে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে আমাকে চেনেন ও স্নেহ করেন। জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। আমি আমার এলাকার মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী কী নির্দেশনা দেবেন, সেটা আমি জানি না। তবে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোতে প্রধানমন্ত্রী আমাদের ভালো জায়গায় রাখবেন, সেটা প্রত্যাশা করি। স্বতন্ত্র এমপিদের মধ্যে স্বতন্ত্র জোট করার বিষয়ে আমার সঙ্গে কেউ কোনো আলোচনা করেনি। আমি এ বিষয়ে জানিও না। সংরক্ষিত সংসদ সদস্যদের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা যোগ্য ও অভিজ্ঞ; দেশের প্রতি ভালোবাসা আছে। তাদের পক্ষ থেকে কাউকে এসব জায়গায় বসানো হলে, আমার আপত্তি থাকবে না।

কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম সরকার। তিনি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও দীর্ঘ সময়ের সাধারন সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন মুরাদনগর উপজেলা পরিষদের প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান। তার একমাত্র ছেলে ডক্টর আহসানুল আলম সরকার কিশোর বর্তমানে মুরাদনগর উপজেলা পরিষদের নৌকা প্রতীকের উপজেলা চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৌশল অবলম্বন করে সফল হয়েছেন। জাতীয় সংসদেও একই কৌশল অবলম্বন করে তিনি একটি কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠা করবেন- এটা আমরা বিশ্বাস করি; তিনি সেটি পারবেন। তিনি বলেন, নৌকা প্রতীক নিয়ে যারা বিজয়ী হয়েছেন এবং আমরা যারা দল করেও দলীয় প্রধানের দেয়া সুযোগ নিয়ে স্বতন্ত্র এমপি নির্বাচিত হয়েছি- উভয় পক্ষকে নিয়ে তিনি একটা সমন্বিত রূপ দিয়ে এই সংসদ পরিচালনা করবেন। নৌকা প্রতীকে বিজয়ী এমপিদের সংসদ নেতা যিনি- তিনি আমাদেরও সংসদে নেতা, সরকারি দলের চিফ হুইপ আমাদেরও চিফ হুইপ। সবদিক বিবেচনা করে পাশাপাশি বসে আমরা একই সংসদে একই আদর্শের অনুসারী হয়ে যার যার ভূমিকা রাখব। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা কামনা করছি।

তিনি বলেন, এই স্বতন্ত্র আর খাঁটি স্বতন্ত্র এক নয়। কারণ স্বতন্ত্রদের ৯৫ ভাগ আমার মতো আওয়ামী লীগরই পদধারী নেতা। আমরা স্বতন্ত্র নির্বাচন করলেও আওয়ামী লীগের ইশতেহারের কথা বলে প্রচারণা চালিয়েছি। গত ১৫ বছরে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে বদলে গেছে, সেই কথা ও উন্নয়নের কথা বলে আমরা মানুষের ভোট নিয়েছি। সুতরাং আমরা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেই এগিয়ে যেতে চাই, এগিয়ে যাব।

স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কোনো জোট করার সম্ভাবনা আছে কিনা জবাবে তিনি বলেন, আমরা এরকম নির্দেশনা এখনো পাইনি। আমাদের দলীয় প্রধান যে নির্দেশনা দেবেন, সেটাই করব। সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যদের বিষয়ে তিনি বলেন, এই বিষয়টি নিয়েও আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। রবিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দেবেন, আমরা সেটাই করব।

প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদও। তিনি কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। এর আগে দ্বেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। দলীয় মনোনয়ন চেয়ে না পেয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নৌকার প্রার্থী রাজি মোহাম্মদ ফখরুলকে হারিয়ে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোন। রবিবার তিনিও গণভবনে আমন্ত্রণ পেয়েছেন।

তার চাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি আওয়ামী পরিবারের লোক। দলীয় পদপদবিও আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষ সব ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে আমাকে ভোট দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেছেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি আরো বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমার চাওয়ার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই আমি মেনে নেব। আমরা স্বতন্ত্র হলেও আওয়ামী লীগের বাইরে নই। সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা এলাকার উন্নয়নের যে রকম সুবিধা পাবেন, আমরাও যেন সেই সুবিধা পাই। তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা, বিশ্বাস করি নেত্রী সেটা করবেন। সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের এমপিদের অনেকেই অনেক রকম কথা বলছেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দেবেন, সেটাই আমি মেনে নেব।

দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত কুমিল্লা-৫(বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত এম এ জাহের। তিনি ব্রাহ্মনপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।

তিনি বর্তমানে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক। স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও দল ও নেত্রীর আদর্শের বাইরে যাবেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার নেত্রী। তার জন্যই আমি রাজনীতিতে এসেছি। তিনি যেটা বলবেন, আমি সেটাই করব। তার সিদ্ধান্তের বাইরে যাব না। কোনো কিছু করব না। রবিবারের বৈঠক সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ডেকেছেন। আমি যাব। স্বতন্ত্র নিয়ে কোনো জোট হলে আপনার অবস্থান কী হবে, জবাবে তিনি স্পষ্ট কিছু বলেননি।

বার্তাবাজার/এম আই