দিগন্ত বিস্তৃত সমূদ্র সৈকত, বালুকাময় রুপালী তটভূমিতে লাল কাঁকড়ার কার্পেট সদৃশ চোখ জুড়ানো সাগর সৈকতে বিশাল জলরাশির ঢেউয়ের গর্জন। পাশে রয়েছে প্রাকৃতিক সবুজ বেষ্টনী কেওড়া বন, সবুজ বেষ্টনীর বনের অন্যতম সৌন্দর্য মায়াবী হরিণের দিকবিদিক ছুটোছুটি আর কিচিরমিচির ডাকে মুখরিত পাখিদের অভয়ারণ্য পর্যটন কেন্দ্র হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ।
এখানে রয়েছে জৌরালি, বাটান, গুলিন্দা, জিরিয়া, পরিযায়ী কয়েক রকম হাঁস ও পরিযায়ী রাজহাঁস, খোয়াজ, তিলা লাল পা, পাতি লাল পা, সবুজ লাল পা, কয়েক রকম গাংচিল ও পানচিল, নানান জাতের চিল, ঈগল, বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙ্গা, শুভ্র সাদা হরেক রকমের বলাকার ঝাঁক আরো নাম না জানা শত শত পাখির এক পাখির স্বর্গরাজ্য। পাখ-পাখালীর মুখরিত হাক-ডাকে দ্বীপের শান্ত প্রকৃতি যেন এক নৈসর্গিক পরিবেশের রূপ ধারণ করে।
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপ ইতোমধ্যে দেশ বিদেশে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা হিসেবে সুনাম রয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে এখানে শীত মৌসুমে প্রচুর পর্যটক সমাগমের ফলে হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ী সহ আর্থিকভাবে সফল হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সুন্দরবনের পর নিঝুমদ্বীপটি হল বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। যা দেখে আকৃষ্ট হবে যে কেউ। প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যে অপরূপ এ দ্বীপটি পর্যটন খাতে খুলেছে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ও পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা বাড়াতে পারলেই ভবিষ্যতে পর্যটন শিল্পে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এ দ্বীপটি। প্রতিবছর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপ্রেমী হাজার হাজার পর্যটক দেখতে আসে অপরূপ সৌন্দর্যের এই নিঝুমদ্বীপে।
সম্প্রতি নিঝুমদ্বীপে বার্ডিং করতে এসেছেন ঢাকা মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল অফিসার ডাক্তার সাজিদ রেজওয়ান। তিনি ২০১০ সালে শখের বসে ছবি তোলা শুরু করলেও ২০১২ সাল থেকে বার্ডিং করা শুরু করেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমন করেছেন তিনি। অংশগ্রহণ করেছেন অনেকগুলো প্রদর্শনীতে। অর্জন করেছেন দেশি-বিদেশী বেশ কিছু পুরস্কার। নিঝুম দ্বীপে কথা হয় তাঁর সাথে।
তিনি বলেন, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি নিঝুমদ্বীপ। সাগর নদীর সংগমস্থলে গড়ে উঠা প্রাকৃতিক সবুজ বেষ্টনী ঘেরা ও এর জীব বৈচিত্র দেখার এক উদগ্র বাসনা থেকে ভ্রমন শুরু ক্যামেরা ও আমার দুই সফরসঙ্গী নিয়ে। দেশের শেষ প্রান্তে, মানুষের কোলাহলমুক্ত, নির্মল বাতাসে একটু নিশ্বাস নেওয়ার আকুল আবেদন থেকে এই ভ্রমণ। কেননা, শহরের ইট-কাঠ-পাথর কনক্রিটে আবদ্ধ বন্দিময় দশা থেকে একদম নিজের অস্তিত্বের খুব কাছাকাছি আসার উদ্দেশ্যে এই ভ্রমণ ছিল অত্যন্ত উদ্দীপ্ত।
নিঝুমদ্বীপে এসে এখানকার কোন কিছুই আমাকে নিরাশ করেনি। দু’চোখ ভরে দেখেছি এর সৌন্দর্য। আর মুগ্ধ হয়েছি। খুব কাছ থেকে দেখেছি কয়েকশো প্রজাতির জীব বৈচিত্র। সৃষ্টিকর্তা যেন ডালা থেকে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলো দিয়ে সাজিয়েছেন এই এলাকাকে। এর সাথে উত্তাল মেঘনার মোহনায় আমাদের ছোট্ট ট্রলারের দোলাদুলিও বেশ রোমাঞ্চকর ছিল।
নিঝুমদ্বীপের বনের মধ্যে প্রবাহমান ছোট ছ্টো খালগুলো দিয়ে ডিঙ্গী নৌকায় ভ্রমন যেন এক স্বপ্ননীল পরিবেশ। বনের বাইরের দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র কূল ঘেঁসে জেগে ঊঠা কাদা-বালির চরে পাখির ঝাঁক ছিল খুবই দৃষ্টিনন্দন। উল্লেখযোগ্য পাখিগুলোর মধ্যে ছিল জৌরালি, বাটান, গুলিন্দা, জিরিয়া, পরিযায়ী কয়েক রকম হাঁস ও পরিযায়ী রাজহাঁস, খোয়াজ, তিলা লাল পা, পাতি লাল পা, সবুজ লাল পা, কয়েক রকম গাংচিল, কয়েক রকম পানচিল, নানান জাতের চিল, ঈগল, বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙ্গা, শুভ্র সাদা বকের ঝাঁক, আরোও কত অজানা এ যেন এক পাখির স্বর্গরাজ্যে আমাদের বিচরণ।
দ্বীপটির ম্যানগ্রোভ বন বা সংরক্ষিত বনের বাফার জোনের মধ্যে অদূরে কোথাও মহিষের দল, আবার কথাও একপাল গরু যেন সবুজের মাঝে মিলে মিশে একাকার। এরি মাঝে শিয়ালের আনাগোনাও ছিল চোখে পড়ার মত। অবারিত সবুজের সমারোহে চিত্রা হরিণের সন্তর্পনে পা ফেলা আবার দূরের কোন আগন্তুকের আওয়াজে চেয়ে থাকা মায়াবী দৃশ্যের অবগাহনে পৃথিবীর বুকে যেন স্বর্গের অবতরণ।
এরি মাঝে আমাদের কাটালো দু’দিন। সারাদিন পানিতে ভেসে থেকে যখন ফিরে আসি, তখনও নতুন মুগ্ধতা। এই এলাকার মানুষ। কী তাদের আতিথেয়তা! যেমনি তাদের মাছের স্বাদ, তেমনি সুস্বাদু তাদের মিষ্টি। চিংড়ি থেকে হাঁস, ভর্তা থেকে ডাল কোনকিছুতেই কমতি ছিলনা একরত্তি। গভীর রাতে জোছনার আলোতে মাছের বার বি কিউ, সে তো আজো মনেহয় মুখে লেগে আছে। চরাঞ্চলের অনেক নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত এই মানুষগুলোর ব্যাবহার যেমন ভাল, তেমনি বড় তাদের কলিজা। অতিথিদের এতটুকু কষ্ট যেন না হয়, সেজন্য কতই না তোড়জোড়!
তবে যাদের কথা না বললেই নয়। তারা হলেন আমাদের মাঝি ভাই ও তার ছেলে। সারাদিন আমাদেরকে আমাদের চাহিদা মত ঘুরাতে একবারও বিরক্ত হন নাই। বরং আমাদের চাহিদা মিটাতে পানিতে ভিজেছেন, কখনওবা চরে আটকে যাওয়া নৌকা হাতে ঠেলেছেন অথবা আবক্ষ কাঁদায় পর্যন্ত নেমেছেন। সবই করেছেন হাসিমুখে। এ যেন জীবনের বড় পাওয়া।
তিনি আরো বলেন, প্রকৃতির বুকে জেগে উঠা এই চর ও এই জীব বৈচিত্রকে টিকিয়ে রাখতে গেলে দরকার আমাদের সদিচ্ছা ও আরো দায়িত্বশীল আচরণ। সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও উচিত এই এলাকাকে রক্ষা করা। রক্ষা করা এই এলাকার পশুপাখিকে। যেখানে সেখানে ফেলে রাখা প্লাস্টিকের বোতল বা চিপসের প্যাকেট আমরা আর দেখতে চাই না এখানে সেখানে। দেখতে চাইনা অবাধে পাখি শিকার কিংবা বিষটোপ দিয়ে অতিথি পাখি মারা। রক্ষা করুন বন ও জীব বৈচিত্রকে। তাহলে এরাই বাঁচাবে আগামীর আপনাকে।
জাহাজমারা রেঞ্জ কর্মকর্তা এস এম সাইফুর রহমান বলেন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র সংরক্ষনে আমাদের বন বিভাগ থেকে সব সময় সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। বিশেষ করে শীতের সময়ে হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপ, ডালচর সহ আশপাশের চরগুলোতে দেশীয় নানা পাখির সাথে অতিথী পাখিরাও আসে। এখানে কেউ যেন পাখি শিকার বা পাখিদের বিরক্ত করতে না পারে সেজন্য আমরা প্রতিনিয়ত টহল অব্যাহত রেখেছি।
নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দিনাজ উদ্দিন বলেন, শীতের সময় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির পাখি নিঝুমদ্বীপের মূল ভূখন্ড সহ আশ-পাশের চরগুলোতে আসে। এটি পর্যটকদের বাড়তি আনন্দের খোরাক। পাখি শিকার সহ পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, গ্রাম পুলিশ এবং বিশেষ করে এলাকার সাধারন জনগন অনেক বেশি সচেতন। পর্যটকরা যেখানে যায় তারা সম্পূর্ণ শতভাগ নিরাপত্তা আওতায় থাকে।
বৈচিত্রময় এ পুরো দ্বীপটিকে ২০০৮ সালের ১৩ এপ্রিল জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষনা করে সরকার। ঘোষনার পর থেকে বেড়ীবাধ, নতুন রাস্তা নির্মান সহ অবকাঠামোগত তেমন কোন উন্নয়ন না হলেও সম্প্রতি সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হচ্ছে দ্বীপের প্রতিটি গ্রাম। তবে সুন্দর এই দ্বীপটির প্রধান সড়ক সহ বিভিন্ন সড়কের বেহালদশা। সড়ক সংস্কার ও উন্নয়ন করা গেলে পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে কয়েকগুণ। তাই দ্রæত যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবি হাতিয়বাসীর।
বার্তাবাজার/এম আই