নীলফামারীতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ডেন্টাল কেয়ার। জেলার অলিগলিতে তাকালে তাদের বাহারি সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। এমনকি রোগীদের আকর্ষণ করতে চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপনসহ রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আলিশান চেম্বার। এসব চেম্বারের সাইনবোর্ডে চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করে টেকনিশিয়ান বা চিকিৎসকের ডিপ্লোমা সনদধারী সহকারীরা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আর প্রশাসনের পক্ষে বিভিন্নসময় জরিমানা করেও বন্ধ হচ্ছে না তাদের কর্মকাণ্ড।

জানা গেছে, নীলফামারী সদর উপজেলায় প্রায় ২৫, সৈয়দপুর উপজেলায় প্রায় ৫৫, কিশোরগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ২০, জলঢাকা উপজেলায় প্রায় ৩০, ডোমার উপজেলায় প্রায় ২৫ ও ডিমলা উপজেলা ২৫ ডেন্টাল কেয়ার রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলা জুড়ে রয়েছে প্রায় শতাধিক ডেন্টাল কেয়ার। দন্ত চিকিৎসায় এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রিধারীগণ চিকিৎসা করানোর কথা থাকলেও নীলফামারীর সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানে কোন ধরনের ডিগ্রী ছাড়াই চিকিৎসা দিয়ে আসছে তথাকথিত দন্ত চিকিৎসকরা। এসব প্রতিষ্ঠানের ডাক্তাররা সহকারী হিসেবে কাজ করে নামমাত্র তিন থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাতারাতি ডাক্তার বনে যান। এদের অনেকের বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন কিংবা প্রশিক্ষণ সনদেও নেই। শুধু তাই নয়, নামে ডাক্তার-ডেন্টিষ্টি এমনকি ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহার করে চটকদার বিজ্ঞাপন, লিফলেটে রোগীদের আকর্ষণ করার চেষ্টার কমতি নেই। সাইনবোর্ডে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নাম ব্যবহার করলেও চিকিৎসা সেবা দেয় ওই প্রতিষ্ঠানের তথাকথিতরাই। এ সুযোগে প্রতিনিয়তই প্রতারিত হচ্ছে রোগী। আর কম খরচে দাঁতের চিকিৎসা হবে ভেবে তাদের রোগীও হয় প্রচুর। অথচ তারা কৌশলে দফায় দফায় মোটা অঙ্কের বিল করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করছে। তার চেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে তারা যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, তা স্টেরিলাইজেশন বা জীবাণুমুক্তকরণের ব্যবস্থা রাখে না ফলে জীবাণু সংক্রামিত হয়। মাসখানেক আগে নীলফামারী সিভিল সার্জন অফিস থেকে ভুয়া ডিগ্রিধারী একাধিক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে নোটিশ পাঠানো হয়। এর পরেও থেমে নেই তাদের কর্মকান্ড। যেমন ডোমারের ফেন্সি ডেন্টাল হোমের ভূয়া ডেন্টিস্ট মোঃ ওমর ফারুককে জরিমানা ও প্রতিষ্ঠানটি সাময়িক বন্ধের পর একই স্থানে ভিন্ন নামে একটি ডেন্টাল কেয়ার খুলে এখনো কর্মরত।

ডোমারের মাদার ডেন্টাল কেয়ারের স্বত্বাধিকারী এবং ওই প্রতিষ্ঠানের ডেন্টিষ্ট দাবিদার মোঃ রাসেল আহমেদের কাছে ১১সেপ্টেম্বর চিকিৎসা নিতে আসেন মোহাম্মদ হাসান নামে এক ব্যাক্তি। চিকিৎসা শেষে ওই রোগী বাড়ীতে যাওর পরে দাঁতে প্রচন্ড ব্যথা ও মুখ ফুলে যাওয়ায় অস্থির হয়ে পড়েন। অন্যত্রে চিকিৎসার জন্য শরণাপন্ন হন এবং তিনি জানতে পারেন তার দাঁতে ইনফেকশন হয়েছে। পরে চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হয়ে মাদার ডেন্টাল কেয়ারের স্বত্বাধিকারী ও ডেন্টিস্ট দাবিদার মোঃ রাসেল আহমেদ ডি.এম.টি ডেন্টাল সরকারি আই.এইচ.টি প্রযুক্তিবিদের বিরুদ্ধে অপচিকিৎসার অভিযোগ এনে নীলফামারী জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জন বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

সৈয়দপুর উপজেলার গোলাহাট এলাকার ভুক্তভোগী জানান, তিনি স্থানীয় এক ডেন্টাল কেয়ারে চিকিৎসা করিয়ে দীর্ঘদিন ভুগে পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডেন্টাল চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে সুস্থ হয়েছেন।

ডোমারের ফেন্সি ডেন্টাল হোমের ডেন্টিষ্ট দাবিদার মোঃ ওমর ফারুকের কাছে চিকিৎসা নেওয়া বাঁধন ইসলাম জানান, ব্যথার দাঁত উঠাতে হবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হয়ে গেলাম। কিন্তু ব্যথার দাঁত নড়বড়ে অবস্থায় উঠালেও রক্ত বন্ধের ব্যর্থ চেষ্টা প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবত চলে। পরে অন্যত্র চিকিৎসা করালে রক্ত বন্ধ হয় এবং সুস্থ হয়। তার অভিযোগের ভিত্তিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ফেন্সি ডেন্টাল হোমের স্বত্বাধিকারী ওমর ফারুককে ৮০ হাজার টাকা জরিমানা ও প্রতিষ্ঠানটি সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয় স্বাস্থ্য বিভাগ। বর্তমান ওই স্থানে ভিন্ন নামে রোগী দেখছেন তিনি।

ওমর ফারুক ডেন্টাল হোমের স্বত্বাধিকারী ডেন্টিষ্ট দাবিদার মোঃ ওমর ফারুক বলেন, আমি ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করে প্র্যাকটিস করছি। আদালতের অনুমতির প্রেক্ষিতে আমার চিকিৎসা পরিচালনা করছি। এছাড়াও আমার এখানে একজন বিডিএস ডিগ্রিধারি বসেন।

মাদার ডেন্টাল কেয়ারের স্বত্বাধিকারী মোঃ রাসেলের সাথে কথা হলে তিনি জানান, বিএমডিসির সাথে আমাদের একটা মামলা চলমান। আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক ১০ বিষয়ে রোগী দেখাশোনা করছেন তিনি।

সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় চিকিৎসা দেওয়া মতো যথেষ্ট বিডিএস ডিগ্রিধারিরা রয়েছে। তবে সিভিল সার্জন অফিস থেকে অনুমতি নিয়ে কোন ডেন্টাল ক্লিনিক এখনো গড়ে উঠেনি। আর চেম্বার খুললে তো অনুমতির প্রয়োজন হয় না। এমবিবিএস কোর্সের মতো চার বছরের বিডিএস (ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি) এবং এক বছরের ইন্টার্নি সম্পন্ন করার পর বিএমডিএস থেকে নিয়ে দাঁতের চিকিৎসা করা যায়। টেকনিশিয়ানরা বিডিএস ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের তাঁদের কাজে সাহায্য করতে পারেন কিন্তু কোনোভাবেই অ্যালোপ্যাথি ওষুধ লেখা বা নিজেই স্বাধীন ভাবে দাঁতের চিকিৎসা করতে পারেন না।

এ প্রসঙ্গে নীলফামারী সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ হাসিবুর রহমান বার্তাবাজারকে জানিয়েছেন, অভিযোগ পেলে তদন্ত করে অভিযান পরিচালনা করা হয়। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ডেন্টাল কেয়ার জরিমানা ও বন্ধ করা হয়েছে। সঠিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে নিয়মিত এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

বার্তাবাজার/এম আই