১৯৭৩ সাল। খুলনার সার্কিট হাউজ মাঠে স্বাধীন বাংলার নেতা বঙ্গবন্ধুর জনসভা। বিশাল সভা নেতাকর্মী আর সাধারণ মানুষে ঠাসা। জনাকীর্ণ সভা শুরু হবার আগে বঙ্গবন্ধু স্থানীয় নেতাকর্মী দের কাছে জানতে চান “নড়াইলের সাত্তার আসেনি-সাত্তার কই” বঙ্গবন্ধু খুঁজছেন সাত্তারকে, উপস্থিত সকলে দেখিয়ে দেন কালিয়া থানার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা সর্দার আব্দুস সাত্তারকে। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, “এ সাত্তার নয় আমার বেদুইন সাত্তার কই”। উপস্থিত নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর এই কথা শুনে হেসে ওঠে। এসময় তার সামনে এগিয়ে আসেন কালিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের সাত্তার মোল্যা। তাকে দেখে বঙ্গবন্ধু বলেন, এই তো বেদুঈন সাত্তার, তুইতো সব জায়গায় ঘুরে বেড়াস-আজ থেকে তোর নাম বেদুইন সাত্তার। সেই থেকে মোল্যা সাত্তার হলেন “বেদুইন সাত্তার”।

নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের সাত্তার মোল্যা। বাবা নোয়াই মোল্যা ছিলেন স্থানীয় মাতব্বর এবং ব্রিটিশ আন্দোলনের নেতা। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিমলীগ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হয়ে যান। ১৯৬০ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে নড়াইল সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করেন। সেই সময় থেকেই যেখানেই বঙ্গবন্ধুর সভা সেখানেই ছুটে যেতেন, সেটি খুলনা হোক অথবা চট্টগ্রাম কোন কিছুই তাকে থামিয়ে রাখতে পারতো না।

বঙ্গবন্ধুর বেদুঈন সাত্তার নড়াইলের নিভৃত একজন রাজনীতিবিদ। ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদী সাত্তার অন্যায় দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। ৬ ফুটের বিশাল দেহের অধিকারী যুবক সাত্তারকে সকলেই একটু সমীহ করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় পাক হানাদার বাহিনী। ঘরে ঢুকে রাজাকাররা গুলি ছুড়ে হত্যা করে আপন ছোটভাই গোলাম সরোয়ারকে, বড়ভাই জাফর আহম্মেদ গুলিবিদ্ধ হন। বেদুঈন সাত্তার পালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ করতেন। পরে ভাইয়ের হত্যাকারী রাজাকার সদস্য মীরাপাড়া গ্রামের আজিজ ওরফে আদাড়েকে হত্যা করেন।

দেশ স্বাধীনের পরে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে কখনও ভাবেননি। তার ছেলে তাকে একবার কালিয়ার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির সামনে হাজির করেন। সেখানে কক্ষে ঢুকেই তিনি এলাকার কয়েকজন কমবয়সীদের দেখেন যারা যাচাই বাছাই কমিটিতে রয়েছেন। সেখানে ঢোকার পরে তিনি তৎকালীন কালিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সহ কয়েকজনকে দেখে রাগে ফেটে পড়েন। বলেন, “এদের কাছে আমার ইন্টারভিউ দিতে হবে?” এই বলে রাগে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।

নানা সংগ্রাম আর প্রতিবাদের মধ্যে কাটানো সাত্তার মোল্যা বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে অনেকটা স্মৃতিশক্তিহীন, বঙ্গবন্ধুর দেয়া বেদুঈন উপাধি নিয়ে আজো চারিদিকে বঙ্গবন্ধুকেই খুঁজে বেড়ান এই মুক্তিযোদ্ধা। একা চলতে পারেন না, কখনো ছেলে কখনো ছেলের বৌয়ের এর হাত ধরে ঘরের বাইরে আসেন। স্মৃতিতে সবই আছে কিন্তু বয়সের ভারে কিছুটা এলোমেলো কথাবার্তা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে এই কথা তিনি মহাকুমা শহর নড়াইলে এসে জানতে পারেন ১৬ আগস্ট সকালে। প্রচণ্ড আঘাত পান মনে। পরদিনই পত্রিকায় সে খবর ছাপা হয়, তিনি জানতে পারেন নিজের বাড়ির সিঁড়িতেই বুলেটে শেষ হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সিঁড়িতে খালি পায়ে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে থাকার কাহিনী শুনে প্রতিজ্ঞা করেন জীবনে আর স্যান্ডেল পায়ে দিবেন না। যেমন প্রতিজ্ঞা তেমনই কাজ এরপর থেকে খালি পায়ে হেটে বেড়াতেন বেদুঈন সাত্তার। ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকরের খবর শুনে ৩৫ বছর পরে তিনি স্যান্ডেল পায়ে দেন এই বঙ্গবন্ধু ভক্ত।

তিনি বলেন, “মরার সময় বঙ্গবন্ধুর পায়ে স্যান্ডেল ছিলো না। এটা জানতে পেরে আমি পায়ের চটি ছুড়ে ফেলে দেই আর পায়ে দেননি। এই অবস্থায় বহুবার উনার মাজার জিয়ারত করতে টুঙ্গিপাড়া গেছি। অনেকবার আমার ছেলেরা স্যান্ডেল জুতা কিনে দিয়েছে, আমি পরতে পারিনি। এরপর যখন খবর পেলাম খুনিদের ফাঁসি হয়েছে তারপর একটা নতুন জুতা কিনে দেয় ছেলেরা সেটা পরেছি”।

দেশ স্বাধীনের আগে বড় জনসভা করতে পারতো না আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু নড়াইলে এলে তখনকার মহাকুমা শহরের ডাকবাংলো মাঠে সভা করতেন। এর আগে দুবার নড়াইলে এসেও সভা করতে না পেরে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোদাচ্ছের মুন্সি, নূরজালালদের সহায়তায় সভা করেছিলেন শহরের অদূরে নয়নপুর প্রাইমারী স্কুল মাঠে। সব সভাতেই তিনি কাছে ডাকতেন সাত্তার কে। প্রচণ্ড ভোজন রসিক সাত্তারকে বঙ্গবন্ধু তাকে কাছে ডেকে খাওয়াতেন। সাত্তারের স্ত্রীর নাম মমতাজ শুনে বঙ্গবন্ধু সাত্তার মোল্যার বড় ছেলের নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন সুজাউদ্দৌলা।

৯৫ বছর বয়সী বেদুঈন সাত্তার এর স্মৃতি এখন দুর্বল, তবে রসিকতা আজো কমেনি। বলেন, ছোট হাসিনাকে আমি ডাকতাম রেনুর পোনা বলে, ভাবির নাম রেনু সেটা মিলিয়ে বলতাম। আর নাসের ভাইয়ের এক পা খোঁড়া ছিলো ওনাকে ডাকতাম তৈমুর লং।

স্থানীয় চাচুড়ি এলাকার প্রবীণ ইলিয়াস শেখ বলেন, বঙ্গবন্ধু মারা যাবার পরে তিনি খালি পায়ে হেঁটেছেন বহুদিন। আগরতলা মামলার সময় আমাদের এলাকা থেকে টাকা চাঁদা তুলে তা বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছে দিতেন।

বেদুঈন সাত্তারের বড় ছেলে সুজাউদ্দৌলা বলেন, মা আমার নাম রেখেছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌস। আব্বার কাছে শুনেছি বঙ্গবন্ধু আমার মায়ের নাম মমতাজ জেনে সম্রাট শাহজাহানের ছেলের নামে আমার নাম রাখেন সুজাউদ্দৌলা।

নড়াইল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ডেপুটি কমান্ডার এড. এস এ সতিন বলেন, সাত্তার ভাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ একজন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে তিনি বহুদিন জুতা/স্যান্ডেল পায়ে দেননি। তিনি একজন প্রকৃত শেখ মুজিব প্রেমী।

বার্তাবাজার/এম আই