কুমিল্লা- ৩ মুরাদনগর আসনে নির্বাচনী লড়াই তুঙ্গে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই আলোচনায় এ আসনটি। মনোনয়নপত্র জমা ও যাচাই-বাছাই থেকেই এ আসন নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। এ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী টানা দু’বারের সাংসদ ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। যিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক ও এফবিসিসিআইয়ের দু’বারের সাবেক সভাপতি।

মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে ১% ভোটার তালিকায় ক্রমিক নম্বরের গড়মিলের অভিযোগে এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম সরকারের মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। পরে সুপ্রিম কোর্ট থেকে তিনি প্রার্থিতা ফিরে পেয়ে নির্বাচনী মাঠে নামেন। কিন্তু নৌকা মার্কার প্রার্থী ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই বিতর্কিত হয়ে পড়েন। তার আশপাশে যারা রয়েছেন তাদের বেশির ভাগই জামাত বিএনপির নেতা এবং নাশকতার ঘটনার এক বা একাধিক মামলার আসামি। পূরো উপজেলার আওয়ামী রাজনীতি জিম্মি করে রাখার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অর্থ ও পেশিশক্তির জোরে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছেন তিনি।

ভোটের দিনও তিনি সন্ত্রাসের আশ্রয় নেন কি-না সে শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সরকার। জাহাঙ্গীর সাহেব নামেই পরিচিত সর্বত্র। মাঠে পুর খাওয়া রাজনীতিক। তিনি লড়ছেন ঈগল মার্কা নিয়ে। স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীর সরকার ছিলেন এ আসনের প্রথম নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান। মুরাদনগরের সন্তান হিসেবে এলাকার প্রতি বিশেষ টান রয়েছে। তাই তো তিনি প্রায়ই ছুটে যান নিজ এলাকায়। তিনি এলাকার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই নির্বাচিত হলে মুরাদনগরের মানুষের কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জাহাঙ্গীর বর্তমানে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কুমিল্লা-৩ আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে ইউসুফ হারুনকে। জাহাঙ্গীরও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের জন্য নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। সাধারণ মানুষ চায়, তিনি যেন নির্বাচন করেন।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের যে ধারা চলছে, তা অব্যাহত রাখার লক্ষ্য নিয়েই তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন।

জাহাঙ্গীর সরকারের পক্ষে ইতিমধ্যে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন মুরাদনগরের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ নেতা। যারা এলাকায় শান্তি চান। যারা পেশীশক্তিকে ঘৃণা করেন। তারা মনে করেন, জাহাঙ্গীর মুরাদনগরকে শান্তির নগর পরিণত করতে পারবেন। অন্যদিকে তাদের কথা ইউসুফ হারুন এলাকায় বিতর্কিত নেতাদের নিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন। যাতে মানুষ আতঙ্কিত। এছাড়া ইউসুফ হারুন এমপি হওয়ার পর একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত তার মনের মতো করে কমিটি দেয়ার অভিযোগ করেছেন নেতারা। কমিটির মূল পদে দেয়া হয়েছে বিতর্কিত ব্যক্তিদের। যাদের অনেকে বিভিন্ন অনিয়ম কর্মকা-ে জড়িত। যাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। রয়েছে পদ ও মনোনয়ন বানিজ্যসহ চাঁদাবাজির অভিযোগ।

যারা বিগত সময়ে বিএনপি করতো অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে দলে ভিড়িয়ে পদ দেয়া ও ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বানিজ্য করার এ সিন্ডিকেটকে নিয়ে নির্বাচনী ময়দানে ইউসুফ হারুন মাঠে নামায় ভোটারদের সমালোচনার মুখে পড়েন। তার প্রতি ভোটারদের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলার বাখরাবাদ এলাকার এক মুদি দোকানি লোকমান হোসেন বলেন, বিগত সময়ে মুরাদনগর ছিল ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন এমপি ও তার লোকজনের হাতে জিম্মি। তাদের অত্যাচার আর নানা কর্মকাণ্ডে মানুষ ছিল অতিষ্ঠ। সে সব কথা মনে হলে এখনও শরীর শিউরে উঠে। মুরাদনগরবাসী এমন সিন্ডিকেট আর চায় না। তাই তারা বুঝে- শুনেই এবার ভোট দেবেন। সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি হিসেবে যিনি ভোটারদের জন্য এগিয়ে আসবেন তিনিই ভোট পাবেন। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ভোটাররা এগিয়ে রাখছেন জাহাঙ্গীর সরকারকে।

এছাড়া জাহাঙ্গীর সরকার যেসব কারণে এগিয়ে রয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো- তিনি ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এমপি নির্বাচিত হলে তার অন্যতম কাজ হবে মুরাদনগরে একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা। মুরাদনগরে একাধিক গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে যা দিয়ে অন্য এলাকায় গ্যাস ভিত্তিক শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে। তবে এ অঞ্চলে একাধিক গ্যাস ফিল্ড থাকায় মুরাদনগরে শিল্পকলকারখানা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জাহাঙ্গীর সরকারের কথা- আমার লক্ষ্য, মুরাদনগরের গ্যাসে একটি শিল্প এলাকা গড়ে তোলা, যাতে মানুষের কর্মসংস্থান করা যায়। এছাড়া মুরাদনগরে শিক্ষার মান ভালো না হওয়ায় তরুণদের চাকরি পেতে সমস্যা হয়। তাই শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য তিনি কাজ করবেন বলেও ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দেন। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন এবং সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা ও ওষুধপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে তিনি ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন। তার এসব প্রতিশ্রুতি মুরাদনগরের মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। সাধারণ ভোটারদের কাছে তাই জাহাঙ্গীর সরকার এগিয়ে রয়েছেন। নির্বাচনে লড়বেন বলেই এসব প্রতিশ্রুতি নয়। আগে থেকেই একজন সফল রাজনীতিক হিসেবে জাহাঙ্গীর সরকার মুরাদনগর ও বাঙ্গরা থানায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করছেন। বিদ্যালয় এমপিওভূক্তি ও কলেজ সরকারিকরন ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

ভবিষ্যতে নির্বাচনী এলাকার ২২ টি ইউনিয়নের সব ক’টিতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে বলে জানান জাহাঙ্গীর সরকার। তিনি বলেন, আমার ১ নম্বর অগ্রাধিকার কর্মসংস্থান। সাধারণ কোনো কর্মসংস্থান নয়, বরং প্রশিক্ষণ দিয়ে তারপর কর্মসংস্থান।

একদিকে শান্তি ও অন্যদিকে আতঙ্ক। এ বিবেচনায় কুমিল্লা-৩ সদর আসনের ভোটাররা শান্তির পক্ষেই থাকবেন বলে জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের শান্তিপ্রিয় ও কোণঠাসা নেতারাও এখন জাহাঙ্গীর সরকারের পক্ষে। তারা বলেছেন, মুরাদনগরের আওয়ামী লীগকে যারা কলঙ্কিত করেছে এবং করছে তাদের সাধারণ মানুষ ক্ষমা করবে না।

ইউসুফ হারুন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাবেক বহিস্কৃত অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমানে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য। কখনো ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতিও করেননি। তবে ২০১৪ সালে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেন ইউসুফ হারুন। জাহাঙ্গীর সরকারের অনুকম্পায় প্রথমে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ পান। তখন থেকেই দমন-পীড়নের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় ইউসুফ হারুনের। রাজনীতিতে প্রবেশ করেই গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনী। মুরাদনগরে এই বাহিনী ‘হাতুড়ি বাহিনী’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ ‘সাদা চামড়ার বাহিনী’- বলেও ডাকে। মোটরসাইকেলে হেলমেট পরে এই বাহিনী নগরের অলি-গলি দাপিয়ে বেড়ায়। তাই অনেকে হেলমেট বাহিনী হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।

জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ ও যোগ্য নেতা থাকলেও ইউসুফ হারুন কাউকেই পাত্তা দেন না। ভয়ে কেউ মুখ খুলতেও সাহস পান না। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইউসুফ হারুন। বলেছেন, তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিরাই এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে পূরনো নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে অনেকগুলো পকেট কমিটি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তার সহযোগিতায় অনেকে চাঁদাবাজি ও পদ বানিজ্য করছেন এমন অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে মুরাদনগর আসনে লড়াই হচ্ছে শান্তির পক্ষে আর অশান্তির বিরুদ্ধে। আজ ভোটে এর প্রয়োগই দেখা যাবে বলে মনে করছেন ভোটাররা।

বার্তাবাজার/এম আই