দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৬ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের ক্ষুদ্র একটি অংশ দলীয় প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপুর সঙ্গে না থাকলেও বেশীর ভাগ আওয়ামী পরিবারের নেতা কর্মীরা সরব আছেন তার পক্ষে। দলীয় কিছু বহিকৃত ও বিপদগামী কর্মী কাজ করছে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে। এতে করে শেষ মুহূর্তে অস্বস্তিতে পড়েছেন নৌকার কর্মী-সমর্থকেরা।

ভোটার ও দলীয় নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়া–৬ আসন। এবার বিএনপি নির্বাচনে না আসায় নৌকার জয়ের ব্যাপারে অনেকটা ‘নির্ভার’ ছিল আওয়ামী লীগ। তবে আওয়ামী লীগের কিছু কর্মী শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান আকন্দকে (ট্রাক) সমর্থন দিচ্ছেন। মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ কবির আহমেদের (ঈগল) পক্ষেও কিছু নেতা কাজ করছেন।

স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সংসদ সদস্য থাকাকালে রাগেবুল আহসানের সঙ্গে দলের অনেক কর্মী-সমর্থকের দূরত্ব তৈরি হয়। বগুড়ায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুই দশকের বেশি সময় ধরে একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন মঞ্জুরুল আলম মোহন। বিশেষ করে যুবলীগের নেতৃত্ব চলে আসছে তাঁর নির্দেশনায়। মঞ্জুরুল আলম এখন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত বছর জেলা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা নিয়ে সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসানের সঙ্গে মঞ্জুরুল আলমের দ্বন্দ্ব হয়। এ ছাড়া নানা বিষয় নিয়ে রাগেবুল আহসানের সঙ্গে শহর যুবলীগের সাবেক নেতা ও বগুড়া পৌরসভার কাউন্সিলর আবদুল মতিন, সদর উপজেলা যুবলীগের সাবেক নেতা এবং বাস মালিকদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর কাউন্সিলর আমিনুল ইসলামসহ বেশ কিছু নেতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয়। রাগেবুল ইসলাম এবারের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেলেও নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচেনি।

এদিকে আবদুল মতিন ও আমিনুল ইসলামের সঙ্গে দূরত্ব ছিল মঞ্জুরুল আলমেরও। কয়েক দিন আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মান্নানের উদ্যোগে মঞ্জুরুল আলমের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কাউন্সিলর আবদুল মতিন ও আমিনুল ইসলাম। সেখানে অন্যদের মধ্যে জেলা শ্রমিক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন শেখ হেলালও উপস্থিত ছিলেন। মঞ্জুরুল আলমের সঙ্গে আলোচিত এ বৈঠকের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। মঞ্জুরুল আলম নৌকার প্রার্থী রাগেবুল আহসানের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব পদেও আছেন।

জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারির উপনির্বাচনে নৌকার পক্ষে এক হয়ে কাজ করেছিলেন। কিন্তু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর রাগেবুল আহসান কথা রাখেননি। তাঁর কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মান্নানের ট্রাক প্রতীকের পক্ষে কাজ করছেন। আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ট্রাক জেতাতে নির্বাচনী কৌশল হিসেবে দীর্ঘদিনের বিরোধ মিটিয়ে মঞ্জুরুল আলমের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। সব দ্বন্দ্ব ভুলে আমরা একসঙ্গে থাকব বলে ওয়াদা করেছি। তিনি যেহেতু জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আছেন, সে কারণে প্রকাশ্য হয়তো নৌকার বিপক্ষে কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু আবদুল মান্নানও শহর আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা। মঞ্জুরুল আলম প্রকাশ্যে ট্রাকের পক্ষে কাজ না করলেও তাঁর সমর্থকেরা এখন ট্রাকের পক্ষে কাজ করছেন।’
এ বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম ফোন ধরেননি।

এমন অবস্থায় রাগেবুল নৌকার প্রচারণায় জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পাশে পাচ্ছেন না। জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুলতান মাহমুদ খান বলেন, কিছুটা সমন্বয়হীনভাবে নৌকার প্রচারণা চলছে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও অঙ্গসংগঠন নিজেদের মতো করে নৌকার প্রচার–প্রচারণা চালাচ্ছে। মঞ্জুরুল আলমের বিষয়ে এই নেতা বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে ওই বৈঠক নির্বাচনী কোনো সভা ছিল না বলে মঞ্জুরুল আলম জানিয়েছেন। ওই বৈঠক ছিল কার্যত পরিবহন ব্যবসা নিয়ে। এরপরও নির্বাচন সামনে রেখে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক করায় ভোটারদের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। মঞ্জুরুল আলম এখন পর্যন্ত সেই বিভ্রান্তি নিরসনে দলীয় সভায় স্পষ্ট করে কোনো বক্তব্য দেননি।

নেতা-কর্মীরা বলেন, মঞ্জুরুল আলম সরাসরি রাগেবুল আহসানের বিরোধিতা না করলেও নৌকার পক্ষে কোথাও কোনো সভা–সমাবেশে এখন পর্যন্ত তাঁকে ভোট চাইতে দেখা যায়নি। তবে দলীয় কার্যালয়ে এসে তিনি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির হয়ে কিছু কার্যক্রম সমন্বয় করছেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মান্নান বলেন, ‘সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর রাগেবুল শুধু আখের গুছিয়েছেন। এলাকার উন্নয়নে কোনো ভূমিকা নেননি। জনগণের কোনো খোঁজও নেননি। জনগণের সুখ–দুঃখে সব সময় নানা সহায়তা নিয়ে পাশে ছিলাম। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত হলে আমার বিজয় সুনিশ্চিত।’

জানতে চাইলে নৌকার প্রার্থী রাগেবুল আহসান বলেন, নৌকা জেতাতে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এককাট্টা। দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব বা বিভেদ নেই। সবাই একযোগে কাজ করছেন।

মঞ্জুরুল আলমের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বৈঠক দোষের কিছু নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি নেই। মঞ্জুরুল আলম নিজেও নৌকার নির্বাচনী কৌশল সমন্বয় করছেন।

রাগেবুল আহসান, আবদুল মান্নান এবং সৈয়দ কবির আহমেদ ছাড়াও এখানে জাকের পার্টির ফয়সাল বিন শফিক, জাপার আজিজ আহম্মেদ এবং এনপিপির শহিদুল ইসলাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

বার্তাবাজার/এম আই