নেই সমবায়ের নিবন্ধন। অথচ ভিন্ন ভিন্ন নামে একই ব্যক্তিরা পাঁচটি সমবায় সমিতির নাম ব্যবহার করে চড়া সুদে গ্রামের অসহায় সহজ সরল লোকদের শোষণ করে আসছিলেন। প্রতারণার এমন ভয়াবহ ফাঁদে ইতিমধ্যে সুদের বোঝা টানতে টানতে কেউ কেউ হারিয়েছেন তাদের শেষ সম্বল মাথা গোঁজার ঠাঁই। অমানুষিক অত্যাচারে বাড়িছাড়া হয়েছে অনেক পরিবার। তবু থেমে নেই তাদের দাদন ব্যবসা। সমবায় অধিদপ্তর এবং উপজেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছিলো এমন নৈরাজ্য। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ০৪ নং ভাংনী ইউনিয়নে সরেজমিনে গিয়ে মিলেছে এসব তথ্য। যেখানে সুদের টাকা আদায়ে এক নারীর কিডনি পর্যন্ত বের করে নিতে কিডনির উপরের মাংস পেশিতে মারাত্মক জখম করেছেন সুদ কারবারিরা।

এ যুগেও সুদের টাকা আদায়ে মধ্যযুগের অমানুবিক পাশবিকতাকে হার মানিয়েছে জালাল, মিলন গং। ছালেহা নামে এক মধ্য বয়সি নারীর মেয়ে জামাই দেলোয়ার হোসেনকে সুদের টাকার জন্য জালাল,মিলন গং- তুলে নিয়ে গিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধর করার খবরে তাকে বাঁচাতে জিম্মাদার হয়ে জামাইকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার পর সময় মতো টাকা দিতে না পারায় ওই নারীকে বাজারের ভিতরে মারধর এবং শেষ পর্যন্ত টাকার বদলা ওই নারীর কিডনি বের করে নিতে হুমকি দিয়ে ডানপাশে কিডনির উপর আঘাত করে মারাত্মক জখম করার অভিযোগ উঠেছে জালাল, মিলন,সোহাগ গংদের বিরুদ্ধে। চিকিৎসক ভুক্তভোগী ওই নারীকে দ্রুত অপারেশন করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ ঘটনায় বাদী হয়ে গত-বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) ছালেহা বেগম, চারজনের নামে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন।

অভিযোগ রয়েছে-মিঠাপুকুর উপজেলার ভাংনী ইউনিয়নস্থ ভাংনী বাজার, বেতগাড়া, নাটাগাড়ি, মাঠের হাট, হাজিরহাট তৎসহ আশপাশের প্রায়-দশ গ্রাম এবং পাঁচটি বাজারে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন ছাড়াই ভিন্ন ভিন্ন নামে চড়া সুদে সমবায় সমিতির নাম ভাঙ্গিয়ে ঋণ দিয়ে আসছিলেন বেতগাড়া গ্রামের মকবুল হোসেনের পুত্র বেলাল হোসেন, জালাল হোসেন, হেলালের ছেলে সোহাগসহ ভাংনী ইউনিয়নের (ইউডিসি) উদ্যোক্তা মিলন মিয়া। ভাংনী বাজার সংলগ্ন স্কুল মাঠে চলতো তাদের এই কথিত সমবায় সমিতি এবং সুদের রমরমা ব্যবসা।

বেতগড়া জনবল সমবায় সমিতি, সুখের সন্ধানে সমবায় সমিতি, বেতগড়া শ্রমজীবি সমবায় সমিতি, সবজি চাষি সমবায় সমিতি এবং মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি নামে প্রায়-৫ টি সমিতির সভাপতি এবং সম্পাদক জালাল এবং মিলন গং। মূলত তাদের ব্যক্তিগত টাকা (নন- জুডিশিয়াল) ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে চড়া সুদে লোক দেখানো সমিতির কথা বলে ঋন দিয়ে লোকজনকে জিম্মি করতেন। সুদের টাকা দিতে না পারলে ভাড়াটে লোকজন নিয়ে গিয়ে ঋণ গ্রহিতাদের তুলে নিয়ে এসে গাছে বেঁধে রাখতেন। এমনকি টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে ভূক্তভোগীদের সন্তান, স্ত্রী এবং বোনদের ধর্ষণের হুমকি দিতেন।

দেলোয়ার হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী জানান, আমি প্রথমে দু’হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। চক্রবৃদ্ধিহারে তাহা ৬০,০০০ (ষাট হাজার টাকা) হয়। পরে তারা কৌশলে আমার কাছে সেটা রিকভারি করে। আমি তিনলক্ষ টাকার উপরে সুদ দিয়েছি। কিন্তু তাদের দাবি, এখনো তারা আমার কাছে চারলাখ টাকা পাবে। আমার বসত ভিটা ছাড়া কিছু নেই। আমাকে তুলে নিয়ে গেলে আমার শ্বাশুড়ি ছালেহা বেগম আমাকে উদ্ধার করে। তিনি টাকা দিতে না পারায় ভরা বাজারে তাকে ও আমার কলেজ পড়ুয়া শালিকাকে মারডাং এবং এই অমানবিক কাজটা তারা করেছে। হামীম নামে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া এক ছাত্র দাবি করেন, তার মা-বাবা চারবছর থেকে মিলন জালাল গংয়ের সুদের টাকার জন্য বাড়ি ছাড়া।

ছালেহা বেগম বলেন, বাবা আমরা গরীব মানুষ। আমার স্বামী রুটির বেকারিতে কাজ করে। জামাইয়ের টাকার জন্য আমাকে তারা উলঙ্গ করে মেরেছে। আমার কলেজ পড়ুয়া মেয়েটাকেও তারা ছাড়েনি। শেষে মিলনের হুকুমে তার ছেলেপেলে আমার কিডনি বের করতে চেয়েছিলো। তাদের আঘাতে আমার কিডনির উপরের মাংসপেশীতে রক্ত জমাট বেঁধে টিউমার আকৃতি ধারণ করেছে। ডাক্তার অপারেশনের পরামর্শ দিয়েছেন। থানায় অভিযোগ দেওয়ার পর আপোষ মিমাংসা করে দেওয়ার কথা বলে পুলিশ ২৬ দিন ঘুরিয়েছে। শুনেছি বিট অফিসারের সাথে মিলনের ভালো সম্পর্ক।

এ বিষয়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের দেখা কিংবা বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে সচেতন মহলের দাবি, সামাজিক অবক্ষয় রোধে এসব সুদ কারবারিদের দ্রুত গতিতে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। এতে সুদ ভীতি থেকে মানুষ জিম্মি দশা থেকে বাঁচতে পারবে। পাশাপাশি সমবায় নামধারী সুদ ব্যবসার হাতিয়ার এসব নামসর্বস্ব ব্যক্তি মালিকানাধীন সমবায় সমিতি বন্ধ করতে তারা প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

মিঠাপুকুর উপজেলা সমবায় অফিসার, মোঃ মাহবুব রানা জানান, সমবায় সমিতির নাম ভাঙ্গিয়ে অনৈতিক কাজ করার সুযোগ নেই। অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে মিঠাপুকুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোস্তাফিজার রহমান জানান, অভিযোগ পেয়েছি। প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে।

বার্তাবাজার/এম আই