বান্দরবান লামার ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় শতকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি ও ২জন নিহত হয়েছে। টানা ৭দিনের বিরামহীন বর্ষণে ৪দিন পানির নিছে ছিলো লামা উপজেলা দুই-তৃতীয়াংশ মত। স্থায়ী বন্যায় দুর্যোগ অবস্থা সৃষ্টি হয়ে ৭আগস্ট সোমবার মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ৬ফুট উচু হয়ে ১১.৯৬ সে.মি. এর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এবারের বন্যা বিগত ১৯৮৭ ও ১৯৯৭ সালের ইতিহাস গড়া বন্যার সকল রেকর্ড ভঙ্গ হলো বলে জানান স্থানীয়রা।

জানা যায়, আকস্মিক বন্যায় লামা উপজেলার অধিকাংশ সরকারি অফিস পানির নিচে ডুবে যায়। এবারের বন্যায় উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউপির কুমারী বাজার পাড়া এলাকায় মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টায় আবুল হোসেনের স্ত্রী করিমা বেগম (৩৫) ঘরের মাটির দেয়াল চাপা পরে মারা গেছে এবং একই দিন দুপুরে রূপসীপাড়া ইউপির এক উপজাতি লোক নদী পার হওয়ার সময় পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া বাড়ীস্থ গাছ ভেঙ্গে পড়ে, পাহাড় ধসে ১৫ জনের অধিক লোক আহত হয় এবং লামা-আলীকদম চকরিয়া সড়কের ইয়াংছা বেইলি ব্রিজ পাহাড়ি ঢলের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যানবাহন চলাচলে বিঘ্নিত সৃষ্টি হয়। তবে বন্যার পানি কিছুটা কমে যাওয়ায় যোগাযোগ মোটামুটি স্বাভাবিক।

পৌর মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, পৌর শহরের এমন কোন ব্যবসায়ী বা বাসিন্দা নাই যাদের বন্যা বা পাহাড় ধসে ক্ষতি হয়নি! দুর্গতদের পাশে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় সরকারি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শীঘ্রই বানবাসী মানুষের সহযোগিতা করা হবে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সরকারি হিসাবের চেয়েও অনেক বেশি।

লামা বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, বন্যার পানি থেকে রক্ষা পেতে যেখানে মালামাল রাখা হয়েছে সেখানে হানা দিয়েছে পানি। কোনভাবে মালামাল রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। একইভাবে আঘাত হেনেছে বন্যা ও পাহাড়ধস উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে। বিভিন্ন ইউপির অধিকাংশ মাটির ঘর (গুদাম ঘর) ভেঙ্গে নিঃস্ব হয়েগেছে। বন্যাজলে ভেসে গেলো নদীরপারের ঘর, হাঁস-মুরগি, গরুছাগল সহ মজুদ রাখা খাদ্যসহ্য। গ্রামীণ সড়ক গুলো অনেকাংশ ভেঙ্গে যোগাযোগ একেবারে বিধস্ত পর্যায়ে। কাঁচা পাঁকা রাস্তা নষ্ট হয়ে গেছে এবং বেশকিছু ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অবকাঠোমোগত ক্ষতির অর্ধশত কোটি টাকার অধিক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বলে জানান উপজেলা প্রকৌশলী কর্মকর্তা আবু হানিফ। সেইসাথে বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক না থাকায় ভোগান্তি চরমে। ফলে কোন চেয়ারম্যান মেম্বারের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে প্রাথমিক হিসাবমতে প্রায় ১হাজার ঘরবাড়ি বিধস্ত, ২হাজারের অধিক পরিবার পানিবন্ধী এবং সাড়ে ৩হাজার মানুষ স্কুল মাদ্রাসা সহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন লামা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাত থেকে আপাতত ১৫ মেট্রিকটন খাদ্যশস্য ১টি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নে বিভাজন করে দেয়া হয়েছে।

লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, পরীক্ষানিরীক্ষার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি পানিতে ডুবে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রত্যেক্ষদর্শীরা জানায় কর্তৃপক্ষের অবহেলায় কোটি টাকার সরকারি জিনিসপত্র পানিতে ডুবে নষ্ট হলো।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, বন্যাজলে প্লাবিত ২০টির অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এলইডি/সিসি টিভি, ফ্যান, আইপিএস, ল্যাপটপ সহ বেশকিছু ফার্ণিচার পানিতে ডুবে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এদিকে অকল্পনীয় বন্যায় লামা খাদ্য গুদামে সরকারি মজুদকৃত খাদ্যশস্যের মধ্যে ১৫০ মেট্রিক টন চাল পানিতে ডুবে নষ্ট হয় বলে জানান উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সেলিম হেলালী।

লামা বিদ্যুৎ বিভাগের আবাসিক প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, শতাধিক বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে গেছে, অসংখ্য স্থানে গাছ পড়ে তাঁর ছিঁড়ে গেছে। লামা সাব স্টেশনে ইয়াংছা সহ কয়েকটি ফিড চালু করা হয়েছে। অসংখ্য বিদ্যুতের লাইন ও মিটার এখনো পানির নিচে। লামা পৌরসভা, রূপসীপাড়া, গজালিয়া, লামা সদর ও বমু বিলছড়ি এলাকায় বিদ্যুৎ চালু করতে সময় লাগবে। আমাদের কর্মীরা বিরামহীন কাজ করছে।

উপজেলা কৃষি অফিসার রতন কুমার বর্মন বলেন, অধিকাংশ আবাদী জমি ও ফসলের মাঠ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। সবধরনের ফসল ও শাক-সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যা ও বৃষ্টির অবস্থা উন্নতি না হলে কৃষিখাত চরম বিপর্যস্থ হবে। তাছাড়া প্রচুর মজুদ সার নষ্ট হয়ে গেছে।

লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, বন্যার শুরুতে ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে মাইকিং করে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয় এবং থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পানিবন্ধী লোকজনকে দিনে-রাতে উদ্ধার করতে অভিযান অব্যাহত ছিল, এমনকি বাড়ীর চাল কেটেও উদ্ধার করা হয়েছে।

লামা উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল বলেন, বন্যার পানিতে পানিবন্ধী মানুষকে নৌকায় করে জনপ্রতিনিধিরা খাবার পৌঁছে দিয়েছে। অনেককে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। এতবড় বন্যার আঘাত ঘুছিয়ে উঠতে সময় লাগবে। সরকারি সহায়তা বাড়ানো খুবই জরুরি। এখনো বন্যার পানিতে নিম্নাঞ্চল ডুবে আছে। লামার বন্যার পরিস্থিতি নিয়ে পার্বত্য মন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বার্তা বাজার/জে আই