ঋতু বৈচিত্র্যের তালিকায় বর্ষাকাল হিসেবে পরিচিত আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস। এ ঋতুতে মুসলধারে বৃষ্টির পানিতে মাঠ-ঘাট থৈ থৈ, নদী-নালা, খাল-বিল কাণায় কাণায় পরিপূর্ণ থাকে। ঋতু আছে, অথচ ঋতুর রীতি বদবিয়ে বিরাগভাজন হয়েছে! এ ঋতু প্রথা অনুযায়ী আষাঢ় মাস পেরিয়ে শ্রাবণের তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও কাঙ্খিত বৃষ্টি বাদলের দেখা মেলেনি বগুড়ার শেরপুরের মাটিতে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছেন আমন চাষীরা। গত কয়েক মাসের চলমান দাবদাহে মাঠের জমি শুকিয়ে গেছে। বিকল্প পদ্ধতিতে সেচ দিয়ে বীজতলা তৈরি করলেও তীব্র পানি সংকটে সময়মত আমন চারা রোপণ করতে পারছেন না কৃষকেরা।

ভরা বর্ষা মৌসুমে তীব্র খরায় একদিকে যেমন আমন চাষ ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিসহ আউশের ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। প্রকৃতির নিয়মে আমন চাষে কৃষকদের খরচ কম হয়। আষাঢ় মাসে কৃষিজমিতে বৃষ্টির জমা পানিতে আমন রোপণ করতেন কৃষকরা। কিন্তু এ বছর বৃষ্টির পরিমান গত কয়েক বছরের চেয়ে অনেক কম হয়েছে।

আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ২৩৩ দশমিক ৫ মিলিমিটার। চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে জুন মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ১২৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার। জুলাই মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৭৬ দশমিক ৮ মিলিমিটার। প্রতিবছর মৌসুমের এ সময় যেসব মাঠে চারদিকে বৃষ্টির পানি থৈ থৈ করতো, সেসব মাঠ এখন শুকনো খেলার মাঠ। মাঝে মাঝে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাতের দেখা মিলছে তাতে শুকনোভাবের মাঠ ভেজাতেও পারছে না। গত কয়েক মাস ধরে প্রচন্ড দাবদাহ অব্যাহত থাকায় খরায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে।

উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনো আমন রোপণ করতে পারেননি বেশির ভাগ কৃষকেরা। এ পরিস্থিতিতে ধান রোপণে বিলম্ব হলে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বৃদ্ধির পাশাপাশি ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই কিছু কিছু এলাকার কৃষক বাধ্য হয়ে গভীর ও অগভীর নলকূপ থেকে সেচের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণ করছেন। এতে জমিতে সেচ দিতে গিয়ে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে তাদের।

উপজেলার শালফা এলাকার কৃষক আতাউর রহমান দুপুরে মাঠে একদিকে জমিতে সেচ দিয়ে কাদা করে পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করে নিচ্ছেন। তবে আরও আগে জমিতে চাষ দেয়া লাগতো। কিন্তু বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা থেকে থেকে শেষ পর্যন্ত সেচ দিয়ে চাষ দিতে হচ্ছে। তাছাড়া প্রতি শতক জমি চাষ দিতে হচ্ছে ১৫ টাকা করে। এরপরও যদি কাঙ্খিত বৃষ্টি না হয় আবার সেচ দিতে হলে জমিতে উৎপাদন হওয়া ফসলের ২ শতাংশ তাকে দিতে হবে। আর যদি টাকায় হয় তবে প্রতি শতকে একজন কৃষকের ৫০ টাকা করে বেশী পড়বে বলে তিনি জানান।

বৃষ্টিহীন অবস্থায় এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে ব্যয় কেমন হতে পারে জানতে চাইলে শেরপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের কৃষক গোলাম রব্বানী ও মাহবুবুর রহমান জানান, জমি প্রস্তুতির জন্য হালচাষ বাবদ স্বাভাবিক সময় ব্যয় হয় ২ হাজার টাকা। এখন প্রকৃতির এমন বৈরী আবহাওয়ার কারণে জমি প্রস্তুত করতে হালচাষ বাবদ অতিরিক্ত ৫-৬’শ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। আমন চাষে কোনো সেচ খরচ করতে হয় না। কিন্তু এখন বর্ষা মৌসুমেও বৃষ্টির দেখা নেই। এবার বোরো মৌসুমের মতোই সেচ দিয়ে আমনের চারা রোপণ করতে হচ্ছে। এতে সেচ বাবদ ২ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে এবার প্রতি বিঘা জমিতে আমন চাষে বাড়তি আড়াই হাজার টাকা থেকে-৩ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে।

বিঘাপ্রতি জমি রোপণের খরচের বর্ণনা দিয়ে তিনি আরও বলেন, জমি চাষকালে টিএসপি ১০ কেজি ৩০০ টাকা, এমওপি (পটাশ) ১০ কেজি ৩০০ টাকা, ইউরিয়া ৫ কেজি ১৫০ টাকা, জিপসাম ১০ কেজি ১৫০ টাকা, দস্তা ১ কেজি ২০০ টাকা, সালফার ৩ কেজি ১২০ টাকা ও ম্যাগনেশিয়াম সার ২ কেজি ৮০ টাকা খরচ করে জমিতে ছিটাতে হচ্ছে। এরপর জমির আইল কাটা বাবদ শ্রমিক ব্যয় ২০০ টাকা, ধানের চারা রোপণ বাবদ ১২০০, আগাছা প্রতিরোধে কিটনাশক ও ইউরিয়া ৫ কেজি বাবদ ১৫০, জমি নিড়ানী বাবদ শ্রমিকের ৫০০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় যোগ হবে।

এছাড়া বেড়ে ওঠা গাছে দ্বিতীয় দফায় আবার ইউরিয়া সার ১০ কেজি ৩০০ টাকা, এমওপি (পটাশ) ৫ কেজি ১৫০ ও ড্যাপ সার ৫ কেজি ১২০, প্রয়োজন অনুযায়ী কিটনাশক ব্যয় ১৫০০, ধান কাটা ও মাড়াই করা বাবদ ৪০০০ এবং বীজ ও বীজতলা তৈরি বাবদ ১ হাজার টাকা ব্যয় করতে হবে কৃষককে। যেসব কৃষকের নিজের জমি নেই তাদের (বর্গাচাষি) জন্য অতিরিক্ত আরও ৭ হাজার টাকা জমি লিজ নেওয়া বাবদ ব্যয় করতে হবে। সব মিলিয়ে আমন মৌসুমের শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে একদিকে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। অন্যদিকে উৎপাদন কম হওয়ায় লোকসান গুনতে হবে চাষিদের।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ফারজানা আকতার জানান, চলতি মৌসুমে শেরপুর উপজেলায় আমনের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমি। এখন পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ১৮ হাজার ৪৮০ হেক্টর। এখনো চাষাবাদ চলমান রয়েছে। গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর জমি। প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টি না হওয়ায় সেচ বাবদ কৃষকের বাড়িতি কিছু টাকা খরচ হবে। আবার যদি ফলন ভাল হয় সে খরচ পুষিয়েও যাবে। আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে কৃষকের সাথে সব সময় যোগাযোগ রাখছি, যাতে তাদের কোন সমস্য না হয়।

বার্তা বাজার/জে আই