‘থানায় কতগুলো অস্ত্র থাকে জানেন? আপনাদের মতো ৫-১০ জনকে ধরে এনে গুলি করে থানার পুকুরে ভাসিয়ে দিলে কিছুই করতে পারবেন না।’ সাতক্ষীরার আশাশুনিতে প্রতারণার মাধ্যমে চিংড়ির ঘের দখল করিয়ে টাকা আত্মসাতের পর ঘেরের মালিকদের এভাবেই হুমকি দেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিশ্বজিৎ কুমার অধিকারী। এর আগে প্রকৃত মালিকদের থেকে ঘের নিজের জিম্মায় নিয়ে অন্যদের দিয়ে দখল করান তিনি। দখলের সঙ্গে সঙ্গে ৫৪ একরের ঘের একদিনেই কেটে শুকিয়ে প্রায় ১৫ লাখ টাকার মাছ ধরে পুরো টাকাই পকেটে পুরেছেন ওসি বিশ্বজিৎ।

বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। লিখিত অভিযোগে ওসি বিশ্বজিৎদের হাত থেকে সম্পত্তির মালিকরা জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছেন। একদিকে সম্পত্তি ও ঘেরে চাষ করা মাছের প্রায় ১৫ লাখ টাকা হারিয়ে অন্যদিকে ওসির নতুন করে হয়রানির হুমকিতে রয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগটি দিয়েছেন সম্পত্তির মালিকদের মধ্যে একজন মো. মোছা মোড়ল। তিনি ইতিপূর্বে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে মামলা নেননি ওসি বিশ্বজিৎ।

লিখিত অভিযোগে মোছা মোড়ল জানিয়েছেন, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি গোকুলনগর গ্রামের কোপাত মোড়লের নেতৃত্বে ৩০-৪০ জন মোছা মোড়ল ও ওয়ারিশদের ৪৫ বিঘার ঘের দখল করতে যান। বিষয়টি নিয়ে তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারি আশাশুনি থানার ওসি বিশ্বজিৎ কুমার অধিকারীর শরণাপন্ন হন এবং আসামিদের বিরুদ্ধে এজাহার জমা দেন। কিন্তু অফিসার ইনচার্জ মামলা নথিভুক্ত না করে কোপাত গং যেন জবরদখল করতে না পারে, এ জন্য থানায় সালিশের প্রস্তাব করেন। অফিসার ইনচার্জের প্রস্তাবমতে পরের দিন বিকেলে উভয়পক্ষ থানায় যান। এ সময় অফিসার ইনচার্জ নির্দেশ দেন যে, আদালতের কোনো নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত ওই সম্পত্তির ওপর কোনো পক্ষ যাবে না। এই মর্মে উভয়পক্ষ থেকে লিখিত স্বাক্ষর করিয়ে নেন।

পরে ১৯ ফেব্রুয়ারি ওই স্থানে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে থানার ওসিকে আদেশ দেন সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দুপক্ষকে নোটিশ জারি করেন এসআই মুহিতুর রহমান। কিন্তু উক্ত নোটিশ জারি করার পর থেকে জমির প্রকৃত মালিক মোছা মোড়লরা সেখানে যাওয়া বন্ধ রাখেন। কিন্তু পরবর্তী কোপাত মোড়ল গং ওই ঘেরে গিয়ে মাছ মারতে শুরু করেন। বিষয়টি নিয়ে অফিসার ইনচার্জকে ২৫ ফেব্রুয়ারি লিখিতভাবে জানানো হলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। এ ছাড়া বারবার ওসি ও এসআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা সময়ক্ষেপণ করে অবৈধ দখলদারদের সুযোগ করে দিতে থাকেন

সবশেষ গত মঙ্গলবার তারিখ বিকেল ৫টায় উভয়পক্ষকে থানায় ডাকেন এসআই মুহিতুর রহমান। কিন্তু ইতিমধ্যে অবৈধ দখলকারীরা ঘের শুকিয়ে ফেলে এবং আনুমানিক ১৫ লাখ টাকার মাছ ধরে বিক্রি করে। মঙ্গলবার থানায় দুপক্ষ হাজির হলে কোপাত মোড়ল একটি লাল রঙের ব্যাগে আনুমানিক ১৫ লাখ টাকা নিয়ে ব্যাগটি অফিসার ইনচার্জকে বুঝিয়ে দেন। আগের রাত থেকে ঘের লুটের মাছ বিক্রি করা সমুদয় টাকা নিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ঘুষ হিসেবে দেন কোপাত মোড়ল। এর আগের দিন রাতে ঘেরে লুটপাট চালানোর জন্য সন্ধ্যায় অফিসার ইনচার্জকে ২ লাখ ও এসআইকে মুহিতুর রহমানকে ৫০ হাজার ঘুষ দিয়ে যান কোপাত মোড়ল।

লিখিত অভিযোগে মোছা মোড়ল জানিয়েছেন, মঙ্গলবার কোপাত মোড়ল অফিসার ইনচার্জের রুমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মোছা মোড়লসহ ঘেরের প্রকৃত মালিকদের ডাকা হয়। কক্ষে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করেন। এ সময় তিনি সিদ্ধান্ত দেন যে, কাল রাতে যারা ঘের দখল করেছে তারাই ঘেরে থাকবে। আমরা সম্পত্তির মালিক হিসেবে সেখানে গেলে আমাদের বিরুদ্ধে উল্টো মামলা নিয়ে গ্রেপ্তার করা হবে। এ ছাড়া এই বিষয়ে কোনো রকম বাড়াবাড়ি করলে কোপাত গং দ্বারা একের পর এক মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়ে জীবন ঝাঁঝরা করে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন। এমতাবস্থায় আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলেন এবং জীবন বাঁচাতে চাইলে চুপচাপ থাকবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন। এ সময় অফিসার ইনচার্জ হুমকি দিয়ে বলেন, থানায় কতগুলো অস্ত্র থাকে জানেন? আপনাদের মতো ৫-১০ জনকে ধরে এনে গুলি করে থানার পুকুরে ভাসিয়ে দিলে কিছুই করতে পারবেন না।

মোছা মোড়ল অভিযোগ লিখেছেন, এ সময় এসআই মুহিতুর রহমান বলেন, আপনাদের বাপ-দাদারা জমি জায়গা রেখে গেছেন। সবাই হজ করে আসেন। হজ করে চুপচাপ গ্রামে থাকবেন। এই ঘটনা নিয়ে কোনো ঝামেলা করার চেষ্টা করলে ওসি স্যার কী বললেন বুঝতে পেরেছেন? একই সঙ্গে ওসি কোপাত মোড়লকে উদ্দেশ করে বলেন, এই ওরা যদি এখান গিয়ে কোনো নড়াচড়া করে তাহলে ওদের সব মহিলার নামে মামলা দিবা। সব মহিলাদের ধরে আগে থানায় এনে পেটাব। পরে জেলে পাঠাব।

এসআই মুহিতুর রহমানের কথা শেষ হলে আমরা কোনো উত্তর না দিয়ে বের হয়ে যেতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই মুহিতুর রহমানকে আমাদের সবার চেহারা ভিডিও করে রাখতে বলেন। এ সময় রুমের মধ্যে আমাদের ভিডিও করা হয়। ভিডিও করার সময় ওসি ভিডিওতে রেকর্ডের উদ্দেশ্যে আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে থাকেন যে, বিষয়টি নিয়ে আপনারা কোর্টে যান।

মোছা মোড়ল অভিযোগ করেছেন, প্রকৃতপক্ষে ১৫ ফেব্রুয়ারি আমার মামলা না নিয়ে পরের দিন সালিশের নামে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত কেউ সম্পত্তিতে না যাওয়ার বিষয়ে উভয়পক্ষের স্বাক্ষর নেওয়ার মাধ্যমে আমাদের সম্পত্তিতে যেন আমরা যেতে না পারি সেই ফাঁদ তৈরি করেন অফিসার ইনচার্জ ও এসআই।। তার সিদ্ধান্ত মেনে আমরা যখন সেখানে না যাই তখন অফিসার ইনচার্জ ও এসআই তাদের তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় অবৈধ দখলদারদের জমির দখল পাইয়ে দিয়েছেন ও লুটপাট এবং মাছের ১৫ লাখ টাকা ঘুষ হিসেবে আত্মসাৎ করেছেন। অবৈধ দখলদাররা জোরপূর্বক দখল নেওয়ার পর তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, জমিতে তারাই অবস্থান করবে এবং এটি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে আমাদের জীবন ঝাঁঝরা করে দেওয়া হবে।

মূলত অফিসার ইনচার্জ ও এসআই কোপাত গংয়ের সঙ্গে পরস্পর যোগসাজশের মাধ্যমে আমাদের সম্পত্তি থেকে কৌশলে নামিয়ে অবৈধ দখলদার কোপাত গং ও তাদের সহযোগীদের অবৈধ দখলের আয়োজন করে দিয়েছেন। এমনকি অফিসার ইনচার্জ ও এসআই উচ্চ আদালতের স্ট্যাটাস-কো, নিজেদের সালিশে দুপক্ষের স্বাক্ষরিত সিদ্ধান্ত, এডিএম কোর্টে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার আদেশ, এসআইয়ের জারি করা নোটিশ; এর কোনোটিই মানেননি।

অফিসার ইনচার্জ ও এসআই মুহিতুর রহমান আমাদের এমন প্রতারণার ফাঁদ পেতে ১৭.৩৪ একর সম্পত্তি অবৈধ দখলদারদের হাতে তুলে দিয়েছেন। একই সঙ্গে ১৭.৩৪ একর সম্পত্তিতে থাকা প্রায় ১৫ লাখ টাকার মাছ লুট করে সেই টাকা কোপাত গংয়ের মাধ্যমে অফিসার ইনচার্জ আত্মসাৎ করেছেন। একই সঙ্গে উল্টো আমাদের মামলায় ফাঁসিয়ে জীবন ঝাঁঝরা করার ভয় দেখাচ্ছেন। ফলে আমরা একদিকে সম্পত্তি লুটপাট, বেদখল ও ১৫ লাখ টাকার মাছের ক্ষতির মুখে পড়েছি। অন্যদিকে কোপাত গংয়ের সন্ত্রাসী বাহিনীর আক্রমণের ও অফিসার ইনচার্জ ও এসআই এর মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয়ে অনিরাপদ জীবন কাটাচ্ছি।

এ বিষয়ে অভিযোগকারী মোছা মোড়ল বলেন, ওসি সাহেব প্রতারণার ফাঁদে ফেলে আমাদের থেকে প্রথমে উনি ঘের নিয়ে নিয়েছেন। পরে এবার অবৈধ দখলদারদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমার আমাদের মাছ লুট করা টাকা তিনি নিয়েছেন। এখন আমাদের মামলা দিয়ে হয়রানির হুমকি দিচ্ছে।

এবিষয়ে অভিযুক্ত অফিসার ইনচার্জ বিশ্বজিৎ কুমার অধিকারীর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি প্রথমে অস্বীকার বলেন, ‘আমি এসব বিষয়ে কিছুই জানি না। তবে তাকে আরও প্রশ্ন করলে ঘটনা জানেন বলে স্বীকার করে বলেন, এটা আদালতের বিষয়। আদালত দেখবেন।’

গুলি করে পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা মিথ্যা কথা। এর কোনো সত্যতা নেই।

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ মতিউর রহমান সিদ্দিকীর বক্তব্য জানতে কল করা হলে তিনি বর্তমানে পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে ঢাকায় থাকায় কথা বলতে পারেননি।

সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সজিব খান জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে অভিযোগ জমা হয়ে থাকলে তদন্ত করে ওসি বিশ্বজিতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এসপির বরাবর অভিযোগ গেলে ওনি অবশ্যই সেটার ব্যবস্থা নেবেন।