কুমিল্লার দেবীদ্বারে ঐতিহ্যবাহী ‘বুড়ি’ নদীরপাড় এবং ফসলী জমির মাটি যাচ্ছে জেলার দেবীদ্বার ও মুরাদনগর উপজেলার অর্ধশতাধিক ইটভাটায়। ভূমি খেকুদের থাবায় পুড়ছে কৃষকের স্বপ্ন, ফসলী জমির উর্বর মাটি। বুড়ি নদীর পাড় ঘেষে যাওয়া বৈদ্যুতিক লাইনের খুটি হেলে পড়ছে। বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। মাটি বহনকারী ট্রাকের চাকায় খানাখন্দ হচ্ছে সড়ক, ধূলাবালির আবরণে সড়কের দু’পাশের বাড়ি-ঘর, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিবর্ণ। ধূলাকণায় নিঃশ্বাসে শ্বাসকষ্ট জনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু-বৃদ্ধসহ সকল শ্রেণীর মানুষ।

সরেজমিনে যেয়ে এমন দৃশ্যের দেখা মিলেছে দেবীদ্বার উপজেলার বড়শালঘর পশ্চিমপাড়া বুড়ি নদীর পাড়ে। ছোটশালঘর বাসষ্ট্যান্ড থেকে কাঁচা রাস্তায় প্রায় ২ কিলো মিটার পশ্চিমে নির্জণ এলাকায় যাবার পথে ‘ফুল মালা ব্রীক্স’ ‘এবিসি ব্রীক্স’সহ বিভিন্ন নামে প্রায় ১৫-১৬টি ড্রাম ট্রাক বুড়ি নদীর চর ও পার্শ্ববর্তী আবাদী জমির মাটি ভেকুর সাহায্যে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এসব মাটি যাচ্ছে দেবীদ্বার ও মুরাদনগর উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটায়।

পথি মধ্যে দেখা হয় প্রখ্যাত মাটি ব্যবসায়ী মো. ইকরামুল হোসেন শিশানের সাথে। তিনি মোটর সাইকেল থামিয়ে বলেন, আমিই মাটি ব্যবসায়ী, আমার সাথে কথা বলুন। কষ্ট করে নদীর চড়ে যেতে হবেনা। অনেকটা জোর করেই ঘটনাস্থলে যেতে হয়েছে।

নদীর পাড়ে মাটি কাটার শ্রমিক আলফাজ আলী সর্দার জানান, এক সময়ের সু-সাধু মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল ‘বুড়ি’ নদী। নদীটি ‘গোমতী নদীর’ মোহনা ছিল।

এছাড়াও এ নদীটি তিতাস নদী এবং কালামুড়িয়া খালের সাথে যুক্ত হয়ে সিলেটের খোয়াই নদীর সাথে মিসে আছে। ১৯৮৬ সালে গোমতী নদীর ভেরী বাঁধ নির্মাণের সময় গোমতী নদীর মোহনায় ইজ গেইট নির্মাণ করা হয়। ওই সময় থেকে বুড়ি নদীটি মৃতপ্রায় স্মৃতি হয়ে আছে। এর পর থেকে ভূমি খেকুরা প্রতিনিয়ত নদীরপাড় দখল করে অর্থ উপার্জনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।

গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ‘আম’ প্রতীকের প্রার্থী মাটি ব্যবসায়ী ইকরাম হোসেন শিশান জানান, এখানে আমার ১৪ একর ৮ শতকের একটি মৎস খামারসহ ছোট বড় ৮টি মৎস খামার রয়েছে। আমি ২২ লক্ষ টাকা খরচ করে সড়ক সংস্কার করেছি। প্রতিদিন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বালু নিধনে ২ হাজার টাকার পানি ছিটিয়ে দিচ্ছি। এছাড়াও প্রতিদিন খানা-খন্দ ও গর্ত হওয়া স্থানগুলোতে মাটি ভরাটের জন্য একদল মাটি কাটার শ্রমিক নিয়োজিত রেখেছি। আমার প্রজেক্টের পশ্চিমে প্রায় ১৫/১৬ গজ দূরে হীরাপুর এবং উত্তরে বাঙ্গরা থানার মহেশপুর আরো ২টি স্থানে বিশাল প্রজেক্ট নিয়ে প্রভাবশালীরা মাটি ব্যবসা করে আসছেন। সবাই শুধু আমাকেই টার্গেট করছেন। আমি আছি সবচেয়ে বেশী বিপদে। এ ব্যবসাটা আর ভালো লাগছেনা, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও সাংবাদিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আছি। দেবীদ্বার, মুরাদনগরসহ জেলার অধিকাংশ সাংবাদিক প্রতিদিনই হানা দেয়। প্রতি মৌসুমে আমার বিপুল পরিমান অর্থ চলে যায় তাদের ম্যানেজ করতে। এ প্রজেক্ট থেকে বছরে ৯০-৯২ দিন মাটি কাটতে পারি। খরচ পুষিয়ে আর মাটি ব্যবসায় লাভ করতে পারছিনা।

স্থানীয় কৃষক জামাল মিয়া জানান, একসময় আমাদের এ এলাকাটি প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নৌকা, তবে এ সড়কটি আমাদের পূর্ব পুরুষগণ ব্যবহার করে আসছিলেন। এখন মাটি টানার ট্রাক এবং ট্রাক্টরের চাকায় খানাখন্দ। বাড়ি-ঘর থাকে ধুলাবালিতে আচ্ছন্ন, রোগ বালাইতো আছেই। প্রতিবাদ করলে বাড়িতে ঘুমাতে পারব না।

ছোটশালঘর বাস স্টেশন সংলগ্নে অবস্থিত বড়শালঘর আলহাজ্ব মোশাররফ হোসেন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থান। বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে দেখা গেল দুইজন শিক্ষিকা এবং পঞ্চম শ্রেণীর তিনজন, চতুর্থ শ্রেণীতে পাঁচজন, তৃতীয় শেণীর চারজনসহ ১১ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। তখনো দ্বিতীয় শিফট এর ১২টার ক্লাশ শুরু হয়নি। একজন শিক্ষিকা বাহিরে চেয়ারে বসে রোদের তাপ নিচ্ছেন, জিজ্ঞেস করলাম বিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতি কেন। জবাবে বললেন, আগে মোটর সাইকেলে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসতেন, সড়কের অবস্থা খারাপ হওয়ায় এবং সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছর একজন শিক্ষার্থী মারা যাওয়ায় অভিভাবকরা আর এ স্কুলে ছাত্র পাঠাননা। বর্তমানে ভর্তি রেজিষ্টারে প্রাক প্রথমিক শ্রেণীর ১৫ জনসহ মোট ৮৩ জন শিক্ষার্থী ও ৪ জন শিক্ষক রয়েছেন। ধূরাবালি এবং সড়কের নিরাপত্তার অভাবে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাশেও আসেনা।

দেবীদ্বার উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ রায়হানুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে কোন অভিযোগ পাইনি। তবে ওই বিতর্কিত জায়গাটির বেশিরভাগ জায়গা মুরাদনগর উপজেলার অধিনে রয়েছে। মুরাদনগরের এসিল্যান্ডের সাথে যোগাযোগ করে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেব।

বার্তাবাজার/এম আই