ইসলামি ব্যাংক টেকনাফ শাখায় গ্রাহকের ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ এর ঘটনায় কারাগারে রয়েছে ব্যাংকটির তিন কর্মকর্তা। অর্থ আত্মসাৎ এর সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থাপক নিজেই অভিযোগ দায়ের করেন। এই ঘটনায় তিন কর্মকর্তা গ্রেফতার হলেও গণমাধ্যমকে বিষয়টিকে গোপন করে ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপক। ব্যবস্থাপকের এমন রহস্যময় আচরনের অনুসন্ধানে নেমে আত্মসাৎকৃত অর্থগুলোর সাথে হুন্ডি সম্রাজ্যের ‘মামু’ নামে পরিচিত এক আন্তর্জাতিক হুন্ডি কারবারীর নাম উঠে এসেছে।

গ্রেফতারকৃত কর্মকর্তারা হলেন- ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখার অফিসার ঈমান হোসেন। সে উপজেলার হৃীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া এলাকার ঠান্ডা মিয়ার ছেলে। জুনিয়র অফিসার আজিজ আহমেদ জাবেদ ও মোহাম্মদ শাহেদুল ইসলাম। এদের মধ্যে আজিজ চট্টগ্রামের পটিয়া জঙ্গলখাইন ইউপির উজিরপুর এলাকার মীর আহমদের ছেলে ও অপরজন পটিয়া জাবিলাছ দ্বীপ ইউনিয়নের চরকানাই এলাকার শেখ আমিনুল হকের ছেলে।

টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ ওসমান গণি জানান, গত বুধবার (১৫ নভেম্বর) অভিযুক্ত ৩জনকে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরন করা হয়। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট টেকনাফ আদালতের বিজ্ঞ বিচারক তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন। পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয় এর উপ-পরিচালক বরাবর ব্যাংক ব্যবস্থাপকের দায়েরকৃত এজাহারটি ফরোয়াডিং করা হয়।

দুদক কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য দুদক প্রধান কার্যালয়ে অনুমতির আবেদন করা হয়েছে। অনুমতি পেলে এই বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করব।

ইসলামি ব্যাংক টেকনাফ শাখার ব্যবস্থাপক মুহাম্মদ অলতাফ হোসেন কাছে জানতে চাইলে তিনি গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ এর বিষয়টি অস্বীকার করে বার্তা বাজারকে জানান, আটক কর্মকর্তারা ব্যংকের নিয়ম ভেঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে। যেটা ব্যাংকের নিয়ম পরিপন্থি। তাই তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছি, সেই অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করে।

এদিকে, ব্যাংক ব্যবস্থাপক ঘটনা অস্বীকার করলেও থানায় তার দায়ের করা এজাহার থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ৬ নভেম্বর ও ১২ নভেম্বর ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখায় দুইজন গ্রাহক মৌখিক ভাবে তাদের হিসাবের স্থিতিতে গরমিলে অভিযোগ করেন। মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে হিসাব দুটির স্থিতির গরমিলের ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, ব্যাংকের কর্মকর্তা ঈমান হোসেন, আজিজ আহমেদ ও জাবেদ তাদের ব্যাংক প্রদত্ত আইডি ব্যবহার করে পরস্পর যোগসাজসে গ্রাহকের চেকবই জালিয়াতির মাধ্যমে ইস্যু করে এবং উক্ত চেকসমূহ ব্যবহার করে নগদ ও ট্রান্সফারের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রাহকের হিসাব থেকে অবৈধভাবে টাকা উত্তোলন করেন। তাদের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রাহকের হিসাবে উক্ত টাকা স্থানান্তর করেন। উক্ত জমাকৃত টাকা পরে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।

ব্যবস্থাপক সর্বমোট ৫৮ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা বিভিন্ন গ্রাহকের হিসাব হতে অননুমোদিত উত্তোলনের প্রমাণ পান। ব্যবস্থাপক বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর দ্রুত আঞ্চলিক প্রধানের মাধ্যমে নিরীক্ষার ব্যবস্থা করেন।

পরবর্তীতে অভিযুক্ত ঈমান হোসেন ঘটনা স্বীকার করে দেয়া লিখিত বক্তব্যে সর্বমোট ৬৫ লক্ষ টাকা একই পদ্ধতিতে আত্মসাতের কথা স্বীকার করেন। বক্তব্যে সে নিজে ৩০ লক্ষ টাকা, আজিজ আহমেদ জাবেদ ৩০ লক্ষ টাকা এবং মোহাম্মদ শাহেদুল ইসলাম ৫ লক্ষ টাকা পারস্পারিক যোগসাজশে মাধ্যমে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন বলে জানান।

এদিকে, অভিযুক্ত ঈমান হোসেন ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাতের কথা স্বীকার করলেও ব্যবস্থাপক এপর্যন্ত ৫৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা অননুমোদিত উত্তোলনের প্রমাণ পেয়েছেন। ব্যাংকের হেড অফিসের নির্দেশ মোতাবেক ব্যবস্থাপক অভিযুক্ত ৩ কর্মকর্তাকে চাকুরী থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেন।

এই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় ব্যাংক ব্যবস্থাপক কর্তৃক গণমাধ্যমকে ভূল তথ্য সর্বরাহ ও বিভিন্ন বাহানার অনুসন্ধানে নেমে ব্যাংকটির বিভিন্ন গ্রাহকের সাথে আলাপে বেরিয়ে এসেছে ভিন্ন তথ্য। তাদের অভিমত কোন সাধারন গ্রাহকের এতো বিপুল টাকা খোয়া গেলে এতদিনে গ্রাহক নিজেই তা প্রকাশ করতেন। কিন্তু এই ঘটনায় এখনো ভূক্তভোগী গ্রাহকের নাম প্রকাশ করেনি ব্যাংকটি, কোন গ্রাহক ওই টাকা তার বলে দাবীও করেনি। এমনকি থানায় দায়ের করা অভিযোগেও কোন গ্রাহকের তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। বিষয়টির সাথে হুন্ডি চক্র জড়িত বলে ধারণা সচেতন মহলের।

তবে, ইসলামী ব্যাংকের এই কেলেংকারীর পর ইয়াছিন ওরফে রহিম উরফে মামু নামের এক ব্যক্তির নাম সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রচার রয়েছে খোয়া যাওয়া টাকার মালিক আন্তর্জাতিক হুন্ডি সম্রাট ইয়াছিন।

কে এই ইয়াছিন?

স্থানীয়রা জানান, এক সময় নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন অবস্থা সম্পন্ন টেকনাফ পৌরসভার জালিয়া পাড়া এলাকার নুর হোসেনের ছেলে ইয়াছিন। স্থানীয়দের কাছে তার পরিচিতি সীমান্তের মাদক ও মানব পাচার কেন্দ্রিক মিয়ানমারে অর্থ পাচার চক্রের অন্যতম হোতা। এক সময় আন্তর্জাতিক হুন্ডি সম্রাট টিটি জাফরের কর্মচারী হিসাবে কাজ শুরু করা ইয়াছিন অল্পদিনের ব্যবধানে বনেগেছে কোটিপতি। কয়েক বছর ধরে টিটি জাফরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে নিজেই গড়েছে হুন্ডি সিন্ডিকেট। অল্পদিনের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক হুন্ডি সাম্রাজ্যে সে রহিম ও মামু নামে পরিচিত।

স্থানীয়রা আরো জানায়, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ আমলে মাদক বিরোধী অভিযান চলাকালে ইয়াছিনকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। কথিত ক্রসফায়ার থেকে বাঁচতে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার বিনিময়ে তাকে আদালতে চালান করে। তার সাথে নামের মিল থাকায় লামার বাজার এলাকার আরেক ইয়াছিনকে কথিত ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী বেশ কজন ব্যাংকের গ্রাহক জানান, ইসলামী ব্যাংক টেকনাফ শাখায় ছিল তার অবাধ যাতায়াত। ব্যাংক চলাকালীন সময়ে ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারের ভেতরে নাকি তাকে প্রায় দেখা মেলে। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন করতেন তিনি। যা সিসি ক্যামেরা ফুটেজ চেক করলে বেরিয়ে আসবে বলে জানান তারা।

অভিযুক্ত ইয়াছিনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও সংযোগ না পাওয়ায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।

এই ঘটনার পরে স্থানীয় এক সাংবাদিকসহ একাধিক সচেতন নাগরিকদের নিজস্ব ফেইসবুকে সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত এই ইয়াছিন ও বার্মায়া মোস্তফার নাম তারা উল্লেখ করেছেন।