গবাদিপশুকে ঘাসজাতীয় স্বাভাবিক খাদ্য খাওয়ানোর নিয়ম। কিন্তু সারা দেশে কতিপয় অসৎ অর্থলোভী খামারি গরুকে দ্রুত মোটাতাজা করতে স্বাভাবিক খাদ্যের সঙ্গে অধিকমাত্রার কৃত্রিম খাবার খাওয়াচ্ছে। গরুকে খাওয়ানো হচ্ছে ব্রয়লার মুরগির খাবার। এক্ষেত্রে ভিটামিন, স্টেরয়েড, আয়রনজাতীয় ওষুধ, ব্রয়লার, পোলট্রি ফিড, ইউরিয়া সার মিশ্রিত খড় খাওয়ানো ছাড়াও ক্ষতিকর ট্যাবলেট ও ইনজেকশন প্রয়োগ করছে। এসব খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধ ফার্মেসি থেকে শুরু করে হাটবাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এ ধরনের গরুর মাংস খেয়ে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। মানুষের শরীরে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া ছাড়াও জটিল রোগের আশঙ্কাও রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া স্টেরয়েড ও হরমোনাল ওষুধ বিক্রি নিষেধ। গবাদিপশুর ওষুধ প্রস্তুত, আমদানি, রপ্তানি ও বাজারজাতকরণে অনুমতির বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর দেখে। এরপরও কেউ গবাদিপশু মোটাতাজাকরণে বিভিন্ন ওষুধ খাওয়ানো বা অনৈতিক পন্থা বেছে নিলে সেটা নীতিবহির্ভূত। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে খোঁজ নেওয়া হবে। প্রমাণ মিললে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনা হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, কোনো ওষুধই অতিরিক্ত গ্রহণ ভালো নয়। স্টেরয়েড ওষুধ ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীটির দেহ স্বাভাবিকভাবেই ফুলে যায়। চর্বি ও কোষ বাড়ে। পশুর শরীরে পানি জমে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ওজন বেড়ে যায়। কিন্তু মাংস বাড়ে না। এতে পশুর হৃৎপিণ্ড, কিডনি ও যকৃৎসহ নানা অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কমে যায় রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। অনেক সময় এসব ওষুধ সেবনে হার্ট অ্যাটাক করে পশু মারাও যেতে পারে। তিনি বলেন, এ জাতীয় প্রাণীর মাংস নিয়মিত খেলে মানুষের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমে। বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধমনি চিকন হয়ে হৃদরোগ ও ব্রেইন স্ট্রোকও হতে পারে।

এদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কেউ নাম প্রকাশ করে কোনো বক্তব্য দিতে চাননি। কেউ কেউ দাবি করেন, সংকটাপন্ন পশুর জীবন বাঁচাতে ওষুধ হিসাবে অনেক সময় স্টেরয়েড দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু তা চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি নিষেধ। সুস্থ পশুকে এ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয় না। এছাড়া যেহেতু অনেক সময় ওষুধ খাওয়ানোর পর পশু মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, সে কারণে লোকসানের ভয়ে খামারিরা এ ধরনের ঝুঁকি নিতে চায় না। এরপরও অনেকে চোরাচালানের মাধ্যমে ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ক্ষতিকর ওষুধ আনছে। অসাধু চক্রের মাধ্যমে খামারিদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। অসৎ খামারিরা তা প্রয়োগও করছে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এসব ওষুধ খাওয়ানো পশুর মাংস খেলে মানুষের শরীরে স্টেরয়েডের উপাদান ঢুকতে পারে। এতে মানুষের কিডনির সমস্যাসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ে। এরপরও বেশি দামের আশায় কম সময় ও স্বল্প বিনিয়োগে অনেকে গরু-মহিষ মোটাতাজাকরণে এ পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন। পশুর ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসাতেও ক্ষতির ওষুধ ব্যবহার করছে। ফলে ছয় থেকে দশ মাসের পশুও প্রাপ্তবয়স্ক মনে হয়।

তারা বলেন, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ মানুষের হাঁপানি রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাজারে পশুর জন্য ডেক্সমেথাসন বা ওরাডেক্সন, ডেকাসন, বেটামেথাসন, পেরিঅ্যাক্টিন, ডেক্রামিথাসন ও কোর্টিসসলের মতো স্টেরয়েড গণহারে বিক্রি হচ্ছে। যা পশুর কিডনি ও যকৃতের কার্যকারিতা নষ্ট করে ফেলে। শরীর থেকে পানি বের হতে দেয় না। এই পানি পশুর মাংসে চলে যায়। যার কারণে মোটা দেখা যায়। এছাড়া পশু মোটাতাজাকরণে বিটামিথাসন, হাইড্রোকর্টিসল ও প্রেডনিসলনের মতো মারাত্মক ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো এতই মারাত্মক যে, মাংস রান্নার পরও তা নষ্ট হয় না। আর স্টেরয়েড মানুষের কিডনি, লিভার, অন্ধত্ব, পুরুষত্ব ও মাতৃত্বহীনতা, ক্যানসারসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর অঙ্গে রোগ সৃষ্টি করে। ফলে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগের সৃষ্টি হতে পারে।

পশু চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গবাদিপশুর ওষুধ উৎপাদনে এক দশক ধরে অন্তত ১৫০ ভেটেরিনারি ওষুধ কোম্পানি গড়ে উঠেছে। দ্রুত সময়ে অধিক লাভের আশায় মানবদেহের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতে ঝুঁকছে। এই তালিকায় নামিদামি কোম্পানির নামও রয়েছে।

নরসিংদী জেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ কোম্পানির ভেটেরিনারি ওষুধ বিপণন করতেন সাদ্দাম হোসেন। সম্প্রতি তিনি চাকরি ছেড়েছেন। রোববার তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, ১ থেকে ১৬ দিন বয়স পর্যন্ত মুরগির বাচ্চার খাদ্য ব্রয়লার স্ট্রাটার, ১৭ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত ব্রয়লার গ্রোআর এবং ২৬ থেকে ৩৫ দিন পর্যন্ত ব্রয়লার ফিনিশার খাওয়ানো হয়। এই খাদ্য শুধু ব্রয়লার মুরগির জন্যই নির্ধারিত। বিভিন্ন উপাদান মিশ্রিত উচ্চমাত্রার এই ব্রয়লার ফিড খেয়েই ২০ থেকে ২৫ দিন বয়সের একটি মুরগির এক থেকে দেড় কেজি ওজন হচ্ছে। গরু খামারিরা এসব দেখে দ্রুত মোটাতাজাকরণের আশায় গরুকেও দেদার পোলট্রি ফিড খাওয়াচ্ছে। গবাদিপশুর রুচি বাড়াতে কয়েকটি কোম্পানির তৈরি ডিজিম্যাক্স ও ডিজিফাস্ট পাউডার খাওয়ানো হচ্ছে। মালয়েশিয়া থেকে আনা ফ্যাট পাউডারও খাওয়ানো হয়। অথচ এ ধরনের পশুর মাংস খেয়ে মানুষের নানা ধরনের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভেটেরিনারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইয়ন অ্যানিমেল হেলথের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কয়েকটি দেশীয় ওষুধ কোম্পানির ক্যাটোফোর্স ইনজেকশন মূলত গরু মোটাতাজাকরণে প্রয়োগ করা হয়। ভয়াবহ তথ্য হলো বর্তমানে অনেক খামারি ব্রয়লার মুরগি বিক্রির দু-একদিন আগে এটাকে পানির সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে দেয়। ফলে ওই মুরগির ওজন একশ থেকে দেড়শ গ্রাম পর্যন্ত বেড়ে যায়। এভাবেই একটি ব্রয়লার ২২ থেকে ২৫ দিনে ১৫০০ থেকে ১৮০০ গ্রাম পর্যন্ত হচ্ছে।

ঢাকার মোহাম্মাদপুর ও কেরানীগঞ্জে একাধিক খামার পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যেক খামারে পশু চিকিৎসক ছাড়াও বিভিন্ন ভেটেরিনারি ওষুধ কোম্পানি যুক্ত রয়েছে। তাদের পরামর্শে পশুর ওষুধপত্র দেওয়া হয়। পাশাপাশি তারা এ-ও জানান, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ পশু মোটাতাজা করতে সহায়ক। তবে এ ধরনের ওষুধ খেয়ে পশু রোগে আক্রান্ত হচ্ছে কিনা এবং এটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী সেটি তারা জানেন না। আবার অনেক খামারি জেনেই এ পন্থা অবলম্বন করছেন। যাতে পশু মোটাতাজা হলে কিছু বাড়তি টাকা পান।